'সবচেয়ে কঠিন তিন শব্দ - আই অ্যাম সরি'

ডেসমন্ড টুটু, তাঁর স্ত্রী নোমালিজো লিয়া শেনজানে ও সন্তানেরা। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
ডেসমন্ড টুটু, তাঁর স্ত্রী নোমালিজো লিয়া শেনজানে ও সন্তানেরা। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

ছেলেবেলায় বাবার হাতে মাকে নির্যাতিত হতে দেখে ব্যথায় কুঁকড়ে যেতেন তিনি। বাবা মাকে পেটাচ্ছেন দেখে কখনো কখনো বাবাকে পাল্টা পেটাতে ইচ্ছা হতো সে সময়। কিন্তু ভালোবাসার এক মানুষকে যখন আরেক ভালোবাসার মানুষ কষ্ট দেয় তখন কী করতে পারি আমরা! ছেলেবেলার এই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি ‘ক্ষমাশীলতা’ বিষয়ে শিখেছেন, মানুষের উদ্দেশে বলেছেন, তাঁর মনে হয় দুনিয়ায় সবচেয়ে কঠিন তিনটি শব্দ হচ্ছে—‘আই অ্যাম সরি’ বা ‘আমি দুঃখিত’।

নিজের শৈশবের এই অভিজ্ঞতা, এ আত্ম-উপলব্ধি জানিয়ে সম্প্রতি ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য গার্ডিয়ান-এ লিখেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সামাজিক অধিকার আন্দোলনের নেতা ও নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী কেপ টাউনের এমিরেটস আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু। এখানে রইল তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর—

এমন অনেক রাত কেটেছে, যখন একটা ছোট্ট ছেলে হয়ে আমাকে অসহায়ভাবে দেখতে হতো আমার বাবা গালাগাল করে শারীরিকভাবে আমার মাকে নিপীড়ন করছেন। এখনো আমি মদের সেই গন্ধটা পাই, মায়ের ভয়ার্ত চোখ দুটো দেখতে পাই এবং ওই অসহায়ত্বকে অনুভব করি যখন আমাদের ভালোবাসার এক মানুষ ভালোবাসার আরেক মানুষকে অবোধভাবে আঘাত করতে থাকে। আমি চাই না কারোরই এই অভিজ্ঞতা হোক, বিশেষত কোনো শিশুর।

স্মৃতিতে ফিরে গেলে আমি বুঝতে পারি, বাবা মাকে যেভাবে মারছেন আমারও ঠিক সেভাবেই বাবাকে পাল্টা মারতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু একটা ছোট্ট ছেলে হিসেবে আমি সেভাবে তাঁকে পেটাতে সক্ষম না। আমি আমার মায়ের মুখ দেখতে পাই, যেই নরম মানুষটাকে আমি এত এত ভালোবেসেছি, যে মানুষটা এমন কিছুই করেননি যাতে তাঁর ওপর এই নির্মম আঘাত নেমে আসতে পারে।

সেসব ঘটনা মনে পড়লে আমি বুঝতে পারি ক্ষমা করার কাজটা কত কঠিন। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আমি এটা বুঝি যে বাবা এই ব্যথা দিয়েছেন, কারণ তিনি নিজেও ব্যথার মধ্যেই ছিলেন। আধ্যাত্মিকভাবে আমি জানি, আমার ধর্ম আমাকে বলে যে বাবারও ক্ষমা পাওয়ার অধিকার আছে; কেননা, ঈশ্বর সবাইকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু তার পরও ক্ষমা করাটা কঠিন। আমরা যেসব মানসিক আঘাতের শিকার হই বা যেসব আঘাতের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পার হই, সেগুলো আমাদের স্মৃতিতে জ্যান্ত থাকে। এমনকি বহু বছর পরও মনে পড়ে গেলে প্রতিবারই তা যেন আমাদের মধ্যে নতুন ব্যথা তৈরি করতে পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৯৮ সালে ডেসমন্ড টুটু ও নেলসন ম্যান্ডেলা। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৯৮ সালে ডেসমন্ড টুটু ও নেলসন ম্যান্ডেলা। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান



বাবার সঙ্গে যদি আমার জীবন বদল ঘটত...আমি যদি আমার বাবার জীবনটা কাটাতাম, আমার বাবা যেসব চাপ আর উদ্বেগের মধ্য দিয়ে গেছেন আমিও যদি সেসবের ভেতর দিয়ে পার হতাম, তাঁকে যেসব দায়িত্বের বোঝা বহন করতে হয়েছে আমাকেও যদি তা করতে হতো তাহলে কী আমিও তাঁর মতোই আচরণ করতাম? আমি জানি না। আমি ভাবি যে আমি হয়তো সে রকম হতাম না, কিন্তু আমি আসলে জানি না।

আমার বাবা মারা গেছেন অনেক দিন হয়েছে, কিন্তু এখন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারলে আমি তাঁকে বলতাম যে আমি তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আমি তাঁকে ঠিক কী বলতাম? আমি হয়তো তাঁকে এটা বলে শুরু করতাম যে বাবা হিসেবে তুমি আমার জন্য চমত্কার যা কিছু করেছে, সে জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু এমন একটা বিষয় আছে যা আমাকে মারাত্মক কষ্ট দিয়েছে। আমি হয়তো তাঁকে বলতাম যে আমার মায়ের প্রতি তিনি যা করেছেন, তা কীভাবে আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং আমাকে ব্যথা দিয়েছে।

হয়তো তিনি আমার কথা বুঝতে পারতেন, হয়তো পারতেন না। কিন্তু তবুও আমি তাঁকে ক্ষমা করে দিতাম।

কিন্তু কেন আমি এটা করতাম? আমি জানি আমার শৈশবের হূদয়কে শান্ত করতে, আমার শৈশবের ব্যথাকে প্রশমিত করার এটাই একমাত্র পথ। ক্ষমাশীলতা অন্যের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে কেউ যখন কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে, আঘাত প্রশমনের জন্য কিছু করতে চায় তখন ক্ষমা করাটা অনেক সহজ। তখন মনে হতে পারে কোনো না কোনোভাবে তোমাকে একটা প্রতিদান দেওয়া হল। তুমি বলতে পারে, ‘আমি তোমাকে কলমটা চুরি করার জন্য ক্ষমা করে দিতে চাই। আমাকে কলমটা ফেরত দিলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব।’ এটাই ক্ষমাশীলতার সবচেয়ে পরিচিত ধরন। আমরা অন্য মানুষটিকে সাহায্য করার জন্য ক্ষমা করি না। আমরা অন্যের জন্য ক্ষমা করি না। আমরা আমাদের জন্য ক্ষমা করি। অন্য ভাষায় বললে, ক্ষমা হচ্ছে স্বার্থপরতার একটা সবচেয়ে ভালো ধরন।
ক্ষমাশীলতার জন্য চর্চা দরকার, সততা দরকার, মুক্ত মনের হওয়া দরকার এবং আন্তরিক ইচ্ছা নিয়ে (বারবার ওই ইচ্ছাটা মরে গেলেও) চেষ্টা করা দরকার। হয়তো আপনি কাউকে ক্ষমা করার চেষ্টা করেও পারেননি। হয়তো আপনি কাউকে ক্ষমা করেছেন এবং তা সত্ত্বেও ওই ব্যক্তি কোনো অনুতাপ দেখায়নি বা নিজেকে শোধরায়নি, নিজের আচরণ পাল্টায়নি বা অপরাধটা করেই যাচ্ছেন—আর তা দেখে আপনার ক্ষমাশীলতাও উবে গেল।

কেউ আঘাত করলে পাল্টা আঘাত করার ইচ্ছা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু পাল্টা আঘাতে খুব কমই সন্তুষ্ট হওয়া যায়। আমরা মনে করি এটা হবে, কিন্তু এটা হয় না। তোমার চড় খেয়ে আমি যদি তোমাকে পাল্টা চড় মারি তাতে আমার মুখে চড়ের ব্যথাটা কমে না, বা তুমি আমাকে আঘাত করায় আমি যে বেদনা পেয়েছি তা-ও কমে না। প্রতিশোধ সাময়িক সময়ের জন্য ব্যথা থেকে নজর সরিয়ে দিতে পারে মাত্র। শান্তি এবং বেদনার প্রশমনের একমাত্র পথ ক্ষমাশীলতা। ক্ষমা করতে না পেরে আমরা আমাদের ব্যথাটাকেই আটকে রাখি, এ থেকে মুক্তি এবং ব্যথা প্রশমনের সম্ভাবনাটা আটকে রাখি, শান্তিতে থাকার সম্ভাবনাটা আটকে রাখি।

ডেসমন্ড টুটু। জন্ম: ৭ অক্টোবর ১৯৩১, ক্লার্কসডর্প, দক্ষিণ আফ্রিকা। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
ডেসমন্ড টুটু। জন্ম: ৭ অক্টোবর ১৯৩১, ক্লার্কসডর্প, দক্ষিণ আফ্রিকা। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

নিজে বাবা হওয়ার পর, সন্তানদের লালন করাটাকে আমার কাছে মনে হয়েছে ক্ষমাশীলতার একটা ম্যারাথন দৌড়ের মতো। অন্যান্য মা-বাবার মতোই আমি ও আমার স্ত্রী লিয়াও (নোমালিজো লিয়া শেনজানে) আমাদের সন্তানদের ব্যর্থতা আর হতাশা সৃষ্টি করার একটা দীর্ঘ তালিকা তৈরি করতে পারতাম। বাচ্চা অবস্থায় ওদের কান্না-চিত্কারে আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটত। এমনকি প্রায়ই আমাদের কোনো একজনকে বিছানা ছাড়তে হতো এবং রাতের ঘুমটা ছাড়াই পরের দিনটা শুরুর জন্য জেগে থাকতে হতো। আর আমরা তো এটা ভেবেই তা করতে পারতাম যে ও তো একটা অবোধ শিশু। শিশুরা এটাই করে। ভালোবাসায় মা-বাবারা সবই মেনে নেন, ওদের পাশে দাঁড়ান, ওদের অসহায় কান্নায় এমনকি কখনো কখনো কৃতজ্ঞ হয়ে পড়েন। বাচ্চাকাচ্চার কান্না-চিত্কার চেঁচামেচিতে অনেক সময় মা-বাবা তাত্ক্ষণিকভাবে বিরক্তিতে প্রত্যুত্তর দিয়ে বসেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই এটা ভেবে অবস্থানটা পাল্টে যায় যে ওই ছোট্ট মানুষটার এখনো অন্য ভাষায় বলতে পারছে না ওর ছোট্ট শরীরে কী ক্ষুধা, কী ব্যথা! আর এতেই নরম হয়ে যায় মা-বাবার মন।

আমাদের সন্তানেরা বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ধৈর্য পরীক্ষা করার নানা পথ (অদ্ভুত সৃষ্টিশীল বটে!) বের করে ফেলে। আমরা নানা সময়ে ওদের ভুলগুলোকে শিক্ষাদানের সুযোগ হিসেবে নিতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই আমরা আসলে যা করেছি, তা হলো ওদের ক্ষমা করে দিয়ে আবারও কোলে টেনে নেওয়া। আমরা জানি, সন্তানেরা এসব ভুলত্রুটির বাইরেও আমাদের কাছে অনেক কিছু। ওদের গল্পগুলো বারংবার ক্ষমাশীলতা চাইতে থাকার একটা রিহার্সাল যেন। আমরা জানি, এমনকি ওদের ভুল কাজগুলোও ওদেরকে বিশ্ব নাগরিক হয়ে ওঠার শিক্ষা দেওয়ার একটা সুযোগ। আমরা ওদের ক্ষমা করতে পেরেছি, কারণ আমরা ওদের ভেতরের মানবতাকে দেখেছি। আমরা ওদের ভালো দিকটা দেখেছি।

ষাটের দশকে দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবাদের ভয়াবহ গ্রাসের মধ্যে ছিল। সরকার কালো শিশুদের জন্য বৈষম্যমূলক বান্টু শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে আমি এবং আমার স্ত্রী শিক্ষকতার কাজ ছেড়ে দিই। আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে আমাদের সন্তানকে কখনোই দক্ষিণ আফ্রিকায় চেপে বসা ওই মগজ-ধোলাই করা শিক্ষাব্যবস্থার শিকার হতে দেব না। আমরা পার্শ্ববর্তী সোয়াজিল্যান্ডের স্কুলে আমাদের সন্তানদের নাম লেখালাম। বছরে ছয়বার করে আমরা ইস্টার্ন কেপের অ্যালিস থেকে আমার বাবার বাড়ি তিন হাজার মাইল দূরের কুরুগার্সডর্পে যাওয়া-আসা করতাম। রাতটা তাঁদের সঙ্গে কাটিয়ে আমরা আরও পাঁচ ঘণ্টার যাত্রায় সোয়াজিল্যান্ডে গিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসতাম বা দিয়ে আসতাম। ফেরার পথে আবার বাবার বাড়িতে একটু বিশ্রাম নিয়ে ওই দীর্ঘ যাত্রার জন্য আবারও নিজেদের প্রস্তুত করে নিতাম। সে সময়ে সেখানে এমন কোনো হোটেল বা বিশ্রামাগার ছিল না, যারা কোনো অবস্থাতেই কোনো কালো মানুষকে থাকার সুযোগ দিত।

এমন কোনো একটা যাত্রায় আমার বাবা আমাকে বললেন যে তিনি কথা বলতে চান। আমি ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। আমরা সন্তানদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ১০ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে এসেছি, রাতে ঘুম নেই। আরও ১৫ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে অ্যালিসে ফিরতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যাঞ্চলের আধা মরুভূমির ভেতর দিয়ে আমাদের ফিরতে হবে। আমি বাবাকে বললাম, কাল সকালে কথা বলব। এটা বলেই আমরা আধঘণ্টা দূরের পথ লিয়াদের বাড়িতে চলে গেলাম। পরদিন সকালেই আমার ভাইঝি এসে খবরটা দিল যে বাবা মারা গেছেন।


আমি শোকে পাথর হয়ে গেলাম। আমি আমার বাবাকে অনেক ভালোবাসতাম, বাবার বদ মেজাজের কারণে আমি মারাত্মক কষ্ট পেলেও তাঁর অন্য অনেক কিছুই ছিল যেগুলো অনেক ভালোবাসার, বুদ্ধিমত্তার এবং প্রজ্ঞার। আর তারপর আমার মধ্যে অপরাধবোধ জেঁকে বসল। তাঁর এই অকস্মাত্ মৃত্যুতে আমার আর কোনো দিনই জানা হবে না যে তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন? তাঁর হূদয়ে কি এমন কোনো পাথর চেপে ছিল, যা আমার সঙ্গে কথা বলে তিনি সরাতে চেয়েছিলেন। উনি কি আমার ছেলেবেলায় আমার মাকে নিপীড়নের জন্য ক্ষমা চাইতে চেয়েছিলেন? আমি কখনোই আর তা জানতে পারব না। নিজের ওই দায়িত্বহীনতার জন্য, বাবাকে শেষবারের মতো আরেকটু সম্মান দেখাতে না পারার জন্য, বাবা আমার সঙ্গে যে অল্প একটু সময় কাটাতে চেয়েছিলেন সেটা পূরণ করতে না পারার জন্য আমি বহু বছর পরও নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি। সত্যি কথা বলতে কি, ওই অপরাধবোধ এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

অনেক অনেক বছর পর আজ যখন মদ্যপ অবস্থায় বাবার ওই আচরণের কথা ভাবি, আমি বুঝতে পারি যে আমার রাগ কেবল তাঁর ওপরই না, আমার নিজের ওপরও। ভয়ে কেঁপে ওঠা একটা ছোট্ট ছেলে হিসেবে আমি উঠে দাঁড়িয়ে বাবার বিরুদ্ধে যেতে পারিনি বা আমার মাকে রক্ষা করতে পারিনি। অনেক অনেক বছর পর, আমি বুঝতে পেরেছি যে আমার শুধু বাবাকে ক্ষমা করলেই চলবে না, নিজেকেও ক্ষমা করতে হবে।

মানুষের জীবন ভালো-মন্দ, সৌন্দর্য, নিষ্ঠুরতা, মন ভেঙে যাওয়া, বোধহীন হয়ে থাকা এবং ভালোবাসাসহ অনেক অনেক কিছুর এক বিরাট সংমিশ্রণ। আমরা সবাইই মানুষের মৌল প্রবৃত্তিগুলোকে বহন করি এবং কখনো উদার আর কখনো স্বার্থপর আচরণ করি। কখনো আমরা চিন্তাশীল হই, কখনো বিবেচনাহীন হয়ে পড়ি, কখনো আমরা দয়াময় হয়ে উঠি এবং কখনো নিষ্ঠুর হয়ে যাই। এটা কোনো বিশ্বাস নয়। এটাই ঘটে।

কেউই মিথ্যাবাদী, ধর্ষক কিংবা সন্ত্রাসী হয়ে জন্মায় না। কেউই ঘৃণাপূর্ণ মন নিয়ে জন্মায় না। কেউই সহিংসতার আকর হয়ে জন্মায় না। কেউই আপনার বা আমার চেয়ে কম মহত্ত্ব বা সম্মান নিয়ে জন্মায় না। কিন্তু যেকোনো দিন, যেকোনো পরিস্থিতিতে জীবনের কোনো ব্যথাতুর অভিজ্ঞতায় এই ভালোত্ব, এই মহত্ত্ব আমরা ভুলে যেতে পারি, আমরা নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারি, নিজের কাছেই অস্পষ্ট হয়ে যেতে পারি। আমরা সহজেই ব্যথা পেতে পারি, ভেঙে পড়তে পারি। এটা মনে রাখা ভালো যে আমরা নিজেরাও সহজেই ওদের মতো হয়ে উঠতে পারি যারা ব্যথা দেয়, যারা আঘাত করে, যারা ভঙ্গে পড়ে।


সহজ সত্য এটাই যে আমরা সবাই ভুল করি, আমাদের সবারই ক্ষমা প্রয়োজন। কোনো জাদুর কাঠি নেই যা দিয়ে আমরা অতীতটাতে পালটে দিতে পারব। যা ভুল হয়েছে তা শোধরাতে না পারলেও যা হওয়া উচিত ছিল আমাদের সাধ্যমতো তা করার চেষ্টা আমরা করতে পারি। আমরা এটা নিশ্চিত করার কাজ করতে পারি যে, অমন আঘাত যেন আর কখনও না ঘটে।

এমন সময় সবার জীবনেই আসে যখন আমরা চিন্তাশূন্য হয়ে পড়ি, স্বার্থপর হয়ে পড়ি। কিন্তু কোনো কিছুই ক্ষমার অযোগ্য না, কোনো ব্যক্তিই দায় মোচনের ঊর্ধ্বে নয়। তবুও, কারও ভুল মেনে নেওয়া এবং ক্ষমা করাটা সহজ না। আমরা যা করে ফেলেছি তার সাফাই গাওয়ার ভাবনা আসতেই পারে। কিন্তু আমরা যদি সাফাই গাওয়া থেকে বেরিয়ে এসে সততা নিয়ে আমাদের কৃতকর্মের দিকে তাকাই তাহলেই আমরা বুঝতে পারব ক্ষমা চাইবার মধ্যেই মুক্তির পথ আছে, আর অপরাধ স্বীকার করবার শক্তি আছে। এভাবেই আমরা নিজেদেরকে অতীতের ভুল থেকে মুক্ত করতে পারি। এভাবেই অতীত ভুলের পুনরাবৃত্তি না করে আমরা ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি।