'সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুন্দরী, শিক্ষিত সংসারী পাত্রী চাই!'

বিয়ের কনে বা পাত্রীকে ‘সম্ভ্রান্ত, শিক্ষিত, ভালো, ছোট পরিবারের মেয়ে হতে হবে’। তাকে ‘সুন্দরী’ তো হতেই হবে। নম্র, ভদ্রসহ নানা গুণ থাকতে হবে। এখানেই শেষ নয়, পাত্রী শুধু শিক্ষিতই নয়, অনার্স বা মাস্টার্স অধ্যয়নরত বা পাস করা থাকতে হবে। উচ্চতা কমপক্ষে পাঁচ ফুট লাগবে। বয়স হতে হবে ২২ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। এভাবেই একটি দৈনিক পত্রিকায় উপযুক্ত পাত্রের জন্য ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। মেয়ের পরিবারও বিয়ের পাত্রী হিসেবে মেয়ের গুণাবলি উল্লেখ করে যোগ্য পাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। পাত্রীর গুণাবলি হিসেবে ফরসা, সংসারমনা, যুগ্ম সচিব, ঢাকায় সুপ্রতিষ্ঠিত প্রকৌশলী কিংবা চিকিৎসক পিতার কন্যা ইত্যাদি বিশেষণও যুক্ত হচ্ছে। মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকে কর্মরত, ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার, বিসিএস ক্যাডার পাত্রীর বেলাতেও লাগানো হয়েছে ‘সুন্দরী’ বিশেষণ। তালাকপ্রাপ্ত পাত্রের জন্যও সুশ্রী, সুন্দরী, শিক্ষিতা, মার্জিত পাত্রী চাই। অপর দিকে পাত্রের বেলায় বিশেষণ বলতে উপযুক্ত, সুপ্রতিষ্ঠিত, উচ্চশিক্ষিত, ঢাকায় অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট ও গাড়ির মালিক আর খুব বেশি হলে সুদর্শন বিশেষণ যোগ হচ্ছে।

বিয়ের জন্য অনেক মেয়ে বা পাত্রী দেখার পরও বিয়ে করতে পারছেন না, এমন এক পুরুষের (৩৮) সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিয়ের এই পাত্র ব্যবসায় সুপ্রতিষ্ঠিত। ঢাকা শহরে নিজের বাড়ি আছে। তবে বিয়ের ক্ষেত্রে তাঁর, বিশেষ করে পরিবারের চাহিদা মেয়েকে শিক্ষিত ও সুন্দরী, নম্র, ভদ্র হতে হবে। শিক্ষিত হবে মেয়ে, তবে বিয়ের পর চাকরি করতে পারবে না। শাশুড়িকে দেখাশোনা করতে হবে। এত সব যোগ্যতা একসঙ্গে কোনো মেয়ের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না, পরিবারের একজনের পছন্দ হলে বোনের হচ্ছে না, বোনের হলে মায়ের হচ্ছে না—তাই বিয়ের কথাবার্তাও এগোচ্ছে না।
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বা নিজেরা বিয়ের চেষ্টায় বিফল হয়ে অনেকেই ঘটকের কাছে যাচ্ছেন। দেশে এখন একাধিক প্রতিষ্ঠানই গড়ে উঠেছে ছেলেমেয়ের বিয়ে ঠিক করার জন্য। রাজধানীতে ঘটক পাখি ভাই প্রাইভেট লিমিটেডের শাখা দুটি। এ প্রতিষ্ঠানের মালিক কাজী আশরাফ হোসেনের নামটিই হারিয়ে গেছে। তাঁকে এখন সবাই চেনে ঘটক পাখি ভাই হিসেবে। ৪৪ বছর ধরে তিনি ঘটকালি করছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার বিয়ে দিয়েছেন।
কাজী আশরাফ হোসেন বলেন, ‘সুন্দরের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম। ফরসা হলেই সুন্দর হবে ব্যক্তিগতভাবে তা আমি মনে করি না। তবে ছেলেপক্ষ এসে কাটা কাটা নাক, হরিণের মতো চোখ, ফরসা ডানা কাটা পরি চায়। মানুষ ওটাই খোঁজে। আগে মেয়েদের ছবি দেখে। ছবি পছন্দ না হলে আর এগোয় না। আর ছেলের বেলায় দেখে ছেলে কী করে।’
মুনমিডিয়া সেন্টার ঘটকালি করছে ১৫ বছর ধরে। এ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাত্রীর যত গুণই থাকুক, সুন্দরী হতে হবে। পাত্র পক্ষের চোখে মেয়েদের সৌন্দর্যটাই “আসল” গুণ। তবে মেয়ে দেখতে খারাপ হলেও বিয়ে যে হচ্ছে না তা নয়। বিয়ে হচ্ছে, তবে কাঠখড় পোড়াতে হয় বেশি।’
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে পাত্রীর যে বর্ণনা থাকে, তা বর্ণবাদী চিন্তা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে আসলে কীভাবে দেখা হয়, তার একটা সাধারণ চরিত্র উঠে আসে এসব বিজ্ঞাপনে। নারীকে যে অন্য কোনো চোখে দেখা হয়, এ তারই প্রকাশ। একদিকে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সমাজের মানসিকতার খুব একটা বদল ঘটেনি। বিয়ের সময় মেয়ের অন্য কোনো যোগ্যতার চেয়ে সে ফরসা কি না, সুন্দর কি না, তা-ই প্রাধান্য পাচ্ছে। পুরুষের বেলায় সৌন্দর্যের চেয়ে যোগ্যতাই আসল। এমনও বলা হয়, ছেলেরা বুদ্ধিমতী মেয়েকে বিয়ে করতে নাকি এখনো ভয় পায়। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষিত মেয়েরাও প্রতিবাদ করে না। এমনটা মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
ছেলেরা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু বিয়ে করার সময় সেই সনাতনী চিন্তার বাইরে যেতে পারছে না। মেয়ে সাংসারিক কি না, মা-বাবাকে দেখবে কি না, সুন্দরী কি না ইত্যাদি চিন্তাই মাথায় ঘুরছে। অর্থাৎ বিয়ে করছে ওই নারী বা বউকে দিয়ে কিছু কাজ সিদ্ধি করতে চাইছে। বউকে টুল বা যন্ত্র হিসেবে ভাবছে। বউ সুন্দরী হলে বংশধর সুন্দর হবে ভাবছে। অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হয়নি। অন্যদিকে নারীদের কাছে এখন পর্যন্ত এত চয়েজ বা পছন্দ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ছেলের মাথায় চুল না থাকলেও টাকা আছে বলা হচ্ছে। শিক্ষিত মেয়েদেরও পরিবারের জন্য ‘স্ট্যাটাস’ হিসেবে না দেখে বাড়তি বোঝা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ ধরনের চিত্র খুবই হতাশাজনক। শিক্ষিত মেয়েরাও অনেক সময় এ বিষয়ে সেভাবে প্রতিবাদ করছে না।