হাসিমুখে ছবি তোলা কবে থেকে শুরু?

রেডি ওয়ান, টু, থ্রি, চিইইইজ…

ছবি তোলার সময় কেউ না কেউ ‘চিজ’ বলে হাসিমুখে তাকাতে বলছে, দৃশ্যটা বেশ পরিচিত। ইংরেজিতে ‘চিজ’ বলুন, কিংবা বাংলায় ‘ইলিশ’—ছবি তোলার সময় এ ধরনের শব্দগুলো আমরা প্রায়ই শুনি। কারণ, ‘চিজ’ বা ‘ইলিশ’ উচ্চারণ করার সময় দাঁত বের না করে উপায় নেইা। আর এই শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই আপনার মুখটি হয়ে ওঠে হাসিমাখা। ছবির মাধ্যমে সুন্দর সময়ের স্মৃতি থেকে যায় আজীবন। তবে শুরুর দিকে ছবি তোলার ব্যাপারটা এ রকম ছিল না। উনিশ বা বিশ শতকের ছবিতে দেখা যায়, সবাই সেখানে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। যেন সবার হাসতে মানা! তাহলে কেমন করে হল হাসিমুখে ছবি তোলার চল? আর কেনইবা এর আগে পাওয়া যায় না হাসিমুখের কোনো ছবি? চলুন জেনে নিই—

ভিক্টোরিয়ান যুগের একটি পেইন্টিং, চরিত্রদের কারও মুখে নেই হাসি
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

হাসতে নাকি জানে না কেউ!

১৮২০ সালের দিকে শুরু হয় ছবি তোলার চল। তারপর এক শতক ধরে ক্যামেরার বিকাশ ঘটতে থাকে। তবে এই ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্যামেরা বিকাশের যাত্রায় ছিল না হাসির কোনো রেশ। বরং হাসিমুখ ছবিকেই তখন মনে করা হতো অশোভনীয়। তাই শুধু বড়রা নয়, শিশুদের ছবির মধ্যেও দেখা যেত না হাস্যোজ্জ্বল কোনো ছবি। এর কারণ ক্যামেরা আবিষ্কার হওয়ার প্রথম দিকে ছবি তোলার কাজটা ছিল বেশ কঠিন। দীর্ঘ সময় ধরে একটি নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। লম্বা সময় হাসি ধরে রেখে দাঁড়ানো সহজ ছিল না। তাই দীর্ঘ সময় ধরে রাখা যায় এমন মুখভঙ্গিই জনপ্রিয় ছিল প্রথম দিকে।

আবার সহজাত হাসির যে সৌন্দর্য, তা ছবি ওঠার সময় অনেকের মধ্যেই থাকে না। ক্যামেরা দেখলেই বরং ভড়কে যেত অনেকে। এ যেন বিশাল এক যন্ত্রের পাশে জোর করে বসিয়ে রেখে হাসানোর এক বৃথা চেষ্টা। তার চেয়ে বরং না হাসা ছবি তোলাই ঢের সহজ ছিল। কারও কারও সারা জীবনে যখন একটিমাত্র ছবি তোলার সৌভাগ্য হতো, তাঁরা সেই সুযোগ হেসে নষ্ট করতে চাইতেন না মোটেও। নিজের শান্ত আর গম্ভীর রূপটাই সবাইকে দেখাতে চাইতেন। যাতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে রয়ে যায় নিজের সেই গাম্ভীর্যপূর্ণ রূপ। অনেকে আবার এটাও বলেন, সেই সময় দাঁতের যত্নে মানুষ সচেতন ছিল না। আবার দাঁতের চিকিৎসাও উন্নত ছিল না। তাই এবড়োখেবড়ো বা পড়ে যাওয়া দাঁত ঢেকে রাখতেও মুখ বন্ধ করে রাখাই ছিল শ্রেয়।

ক্যামেরার সামনে হাসার চল খুব বেশি দিনের না
ছবি: পেক্সেলস ডটকম

হাসিমুখের উত্থান

ক্যামেরাকে কে জনপ্রিয় করেছে—এ কথা উঠলে কোডাক কোম্পানির কথাই আসবে সবার প্রথম। ছবি তোলাকে মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে নিয়ে আসার পুরো কৃতিত্বটাই যেন কোডাকের! জটিল সব ক্যামেরার যন্ত্রপাতিকে এক ঝটকায় দূর করে দিয়েছিল ক্যামেরার এই ব্র্যান্ড। ক্যামেরা হয়ে উঠে সহজে ‘ক্যারি’ করার মতো যন্ত্র। তবে হাসিমুখের ছবি তোলার সঙ্গেও যে কোডাকের নাম জড়িত, সে কথা কি আপনারা জানেন?

বিশ শতকের শুরুতে কোডাক যখন প্রথমে সহজে বহনযোগ্য ক্যামেরা নিয়ে আসে, তখন তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল মানুষকে ক্যামেরার সঙ্গে সহজ করে তোলা। তাদের ক্যামেরাভীতি কাটানো। এ জন্য তারা এক অভিনব মার্কেটিং ক্যাম্পেইন করে। ফটোগ্রাফি ম্যাগাজিনে একের পর এক হাসিমুখের ছবি প্রকাশ করতে থাকে। নিচে স্লোগান জুড়ে দেয়, ‘সেভ ইয়োর হ্যাপি মোমেন্টস উইথ আ কোডাক’ অর্থাৎ ‘আপনার সুখী মুহূর্তকে কোডাকে ধরে রাখুন।’ আর এই স্লোগানের মাধ্যমেই এক নতুন যুগের সুচনা করে কোডাক।

ছবি তোলাকে মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে নিয়ে আসার পুরো কৃতিত্বটাই যেন কোডাকের!
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

কোডাকের ক্যামেরায় ছবি তুলে ক্রেতারাই শেয়ার করতে থাকেন একের পর এক হাসিমুখ ছবি। ধীরে ধীরে এই হাসিমাখা মুখ পরিচিতি পেতে থাকে চারদিকে। অন্যান্য কোম্পানিও তাদের প্রচারণায় ব্যবহার করতে থাকে হাসিমুখ মডেলের ছবি। এমনকি ১৯৫০ সালের দিকে প্রেসিডেন্টরা পর্যন্ত হাসিমুখে ছবি তোলা শুরু করেন। এভাবেই ঘটে যায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন।

গাম্ভীর্যকে দূরে সরিয়ে সহজাত হাসিই হয়ে ওঠে ছবি তোলার মূল ভঙ্গি। ক্যামেরা হয়ে ওঠে সুখের দিনকে বন্দী করে রাখার এক আলাদিনের প্রদীপ। যেখানে পুরোনো ছবির দিকে তাকালেই মন অজান্তেই গুনগুনিয়ে ওঠে, ‘ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়!’