সামনে মেসি, অথচ আমার ‘মেসি মেসি’ চিৎকার করার উপায় নেই
ছোটবেলা থেকে আমার কাছে বিশ্বকাপ মানে ছিল আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিল। কিন্তু ১৬ নভেম্বর মধ্যরাতে যখন পা রাখলাম কাতারের দোহা বিমানবন্দরে, তখন বুঝলাম, এই উন্মাদনা আসলে দুই দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে কাতারের পথে পথে নানা দেশের ভক্ত, সমর্থকদের যে সাজ সাজ রব, তা দেখলে বোঝা যায়, কেন ফুটবল বিশ্বকাপকে বলা হয় ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’।
ফিফার আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এবার কাতারে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছে আমার। গত বছর অক্টোবরে ফিফা আরব কাপেও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় এবার বিশ্বকাপ শুরুর মাসখানেক আগে ফিফা আমাকে ই-মেইল করে জানতে চায় যে বিশ্বকাপে থাকতে আমি ইচ্ছুক কি না। দ্বিতীয়বার না ভেবেই আমি আমার আগ্রহের কথা জানিয়ে দিই। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স) আমার শেষ বর্ষ চলে। পড়ালেখার এত চাপের মধ্যেও ক্লাস-কুইজ সব শেষ করে শিক্ষকদের আন্তরিক সহযোগিতায় এই মহাযজ্ঞে হাজির হতে পেরেছি।
আমার সামনে পুরো পৃথিবীর ফুটবলের রথী মহারথীরা অনুশীলন করছেন, খেলছেন। মাত্র ২০ ফিট দূরত্বে থেকেও লিওনেল মেসি বা লুক মদ্রিচের মতো তারকাদের দেখছি—মাঝেমধ্যে মনে হয় এর সবই স্বপ্ন। আমার সঙ্গে পুরো বিশ্ব থেকে আসা প্রায় পাঁচ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের অনুভূতিও বোধ হয় একই।
যখন এই লেখা লিখছি, তত দিনে আমি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং দুটি ম্যাচে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে ফেলেছি। নিজ চোখে সামনে থেকে দেখেছি বলে বলছি না, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটির তুলনা আর কোনো কিছুর সঙ্গেই হয় না। কাতারের বিস্ময় বালক গনিম-আল-মুফতাহ্-এর অসাধারণ অভ্যর্থনা এবং অভিনেতা মরগান ফ্রিম্যানের ভরাট কণ্ঠে শান্তি ও সাম্যের উদাত্ত আহ্বান ৮০ হাজার দর্শকের সঙ্গে স্বচক্ষে দেখতে পারার অনুভূতি বিশেষ কিছু।
তবে আমার জন্য সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা অপেক্ষা করছিল পরের দিনটিতে। আমার পছন্দের দল আর্জেন্টিনা মাঠে নেমেছিল সেদিন। আর আমার দায়িত্ব ছিল ওই দিন, ওই স্টেডিয়ামেই! মেসিকে দেখব—এই উত্তেজনায় সারা রাত ঘুম হয়নি। খেলা শুরু হওয়ার আধঘণ্টা আগে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রথমবারের মতো মেসিকে দেখলাম, পুরো আর্জেন্টিনা দল তখন ওয়ার্মআপ করতে মাঠে। গোটা স্টেডিয়াম ‘মেসি মেসি’ রবে উন্মাতাল। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মাঠে আমার নিরপেক্ষ থাকতে হয়। সে কারণে ‘মেসি মেসি’ বলে চিৎকার করতে পারিনি ঠিকই, তবে সামনে থেকে পুরো খেলা দেখতে পেরেছি, এটাই আমার জন্য অনেক। দিন শেষে ফলাফল যা-ই হোক না কেন, মেসিদের খেলা সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা, আর এত এত দর্শকের সঙ্গে কথা বলা ও ভাব আদান-প্রদান করতে পারার যে অভিজ্ঞতা ঝুলিতে জমা হচ্ছে, তা-ই বা কম কিসে।
স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আমরা কী কাজ করছি, সেটা নিয়ে একটু বলি। কাতারে এবার মোট আটটি মাঠে খেলা হচ্ছে। প্রতিদিন চারটি মাঠে খেলা থাকে, এবং প্রায় এক হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রতি খেলায় প্রতি মাঠে বিভিন্ন কাজে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যান। এসব কাজের মধ্যে আছে দর্শক ব্যবস্থাপনা, আপ্যায়ন, মিডিয়া অ্যান্ড অপারেশন, তথ্যপ্রযুক্তিসেবা ইত্যাদি। প্রতিটি দলের জন্য আবার কয়েকজন তত্ত্বাবধায়ক থাকেন। আমি মূলত দর্শক ব্যবস্থাপনা দলের সঙ্গে কাজ করছি। স্টেডিয়ামের ভেতরে, বাইরে এবং প্রবেশের সময় দর্শকের আসন খুঁজে পেতে সহায়তা করা, তাঁদের পথ চিনিয়ে দেওয়া, কোনো প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া, এই সবকিছুই আমরা করি।
প্রতিদিন ম্যাচ শুরু হওয়ার পাঁচ ঘণ্টা আগে আমাদের শাটল বাসে করে স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য ‘ওয়ার্ক ফোর্স’ সেন্টার আছে। চেক ইন করে, হালকা খাবার নিয়ে আমরা যার যার জায়গায় চলে যাই। খেলা শুরু হওয়ার দুই ঘণ্টা আগে দর্শকদের জন্য গেট খুলে দেওয়া হয়। তখন শুরু হয় আমাদের মূল কাজ। খেলা শেষ হওয়ার পর এক ঘণ্টা পর্যন্ত আমাদের থাকতে হয়। তারপর আবার শাটল বাসে করে আমাদের থাকার জায়গা ‘জাহরাত আল বায়ুত’-এ ফিরিয়ে আনা হয়। এই ‘জাহরাত আল বায়ুত’ নিয়ে আরেক দিন লেখা যাবে। আপাতত সামনের দিনগুলোতে আরও নামী খেলোয়াড়দের সঙ্গে দেখা করার সুযোগের অপেক্ষায় আছি।