বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা: সমস্যা ও সম্ভাবনা

এম রিজওয়ান খান
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দক্ষ জনশক্তি উৎপাদনের পাশাপাশি সৃজনশীল গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করবে, এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ ধরনের কার্যক্রমের পরিধি একেবারেই সীমিত। আমরা যদি এর কারণ অনুসন্ধান করি, তাহলে বেশ কিছু মৌলিক সমস্যা দৃষ্টিগোচর হয়।

১. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণের পদ্ধতিতে গবেষণার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যেমন অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে নামমাত্র গবেষণা প্রবন্ধের ভিত্তিতে অধ্যাপক পদ পর্যন্ত উত্তরণ সম্ভব। সুতরাং গবেষণা করা তাঁদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।

২. গবেষণার জন্য নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে খরচ করার মতো যথেষ্ট অর্থ নেই। এ ছাড়া গবেষণার অগ্রগতি নিরীক্ষণ ও পদ্ধতি মূল্যায়নও যথোপযোগী নয়। ফলে গবেষণা খাতে যে অপ্রতুল বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার একটি বড় অংশ সাফল্যমণ্ডিত হয় না। তাই একদিকে যেমন গবেষণা বরাদ্দ বাড়ানো উচিত, অন্য দিকে গবেষণা মূল্যায়নের নীতিমালাও ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। গবেষণার জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আমরা এইচইকিউইপির (হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট) একটি বড় অঙ্ক বরাদ্দ পেয়েছি। তবু গবেষণায় যতটা উন্নয়ন হওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। কারণ, গবেষণা বরাদ্দের সঙ্গে সঙ্গে গবেষণা মূল্যায়নের বাস্তবমুখী নিয়ম থাকা দরকার। এটি সঠিকভাবে না থাকার কারণে গবেষণা খাতের অর্থের অপচয় রোধ করা যায়নি।

ইউআইইউতে আছে ব্রেন কম্পিউটার ইন্টারফেস (বিসিআই) ল্যাব
ছবি: সংগৃহীত

৩. শিক্ষকদের ওপর কোর্স পরিচালনার চাপ কমিয়ে গবেষণা পরিচালনার জন্য সময় বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে কোর্স পরিচালনার চাপ এত বেশি থাকে যে অধিকাংশ শিক্ষকই গবেষণায় সময় দিতে পারেন না। শিক্ষকদের গবেষণার সময় বাড়াতে গেলে কোর্সের চাপ কমাতে হবে। অর্থাৎ আরও বেশিসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এর ফলে খরচ বাড়বে। উন্নত দেশগুলোয় গবেষণার খরচের এক বিরাট অংশ আসে শিল্প খাত (ইন্ডাস্ট্রি) থেকে। এ ধরনের গবেষণার খরচের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ মেটাতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের শিল্প খাতে গবেষণার মানসিকতা এখনো মৌলিক পর্যায়ে আছে, যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার খরচ নিজস্ব আয় থেকে বহন করতে হয়। তাই শিক্ষকদের কোর্সের চাপ কমিয়ে গবেষণার জন্য সময় বাড়ানোর ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে খুব একটা উৎসাহ দেখা যায় না।

এত সব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ) গবেষণায় উৎসাহিত করার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষক ইউনাইটেড গ্রুপের দেওয়া এককালীন ১০ কোটি টাকা অনুদানের ওপর ভিত্তি করে ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ (আইএআর;
iar.uiu.ac.bd) এর মাধ্যমে ইউআইইউ গবেষণা কার্যক্রম শুরু করে। এ প্রক্রিয়ায় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানকেও আমরা সম্পৃক্ত করেছি। এখন প্রায় ১১০টি গবেষণা প্রকল্পে ৪৭টি দেশি ও ৫১টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত আছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের স্বনামধন্য বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব), সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে। ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা, মালয়েশিয়াও এ প্রকল্পে অংশীদারত্ব চুক্তিতে যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি শিল্প বা বাণিজ্যিক সংস্থাও ইউআইইউর গবেষণা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে। ইউআইইউর গবেষণা প্রকল্পের সফলতার একমাত্র মাপকাঠি হচ্ছে মানসম্মত (স্কোপাস ইনডেক্সড) জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশ। ইউআইইউ গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার প্রচেষ্টায় যে অর্থ বরাদ্দ দেয়, তা হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নের অর্থায়ন (সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা), গবেষণা প্রকাশনা ফি (সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা), গবেষণাসহায়ক ছাত্র–ছাত্রীদের প্রণোদনা (১৫ হাজার টাকা) এবং গবেষকদের প্রণোদনা (কনফারেন্সে যোগদানের জন্য ৫০ হাজার টাকা ও গবেষণা প্রকাশনাপ্রতি ২৫ হাজার টাকা)।

আমাদের এই উদ্যোগ প্রমাণ করে যে সুষ্ঠু নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে গবেষণায় সহায়তা এবং উৎসাহ দেওয়া হলে খুব দ্রুতই দেশের গবেষণা সংস্কৃতিতে এক বিরাট পরিবর্তন আনা সম্ভব।