গান গেয়ে ছাদ পেটানোর পেশাটি কি হারিয়ে যাচ্ছে

গান গেয়ে গেয়ে ছাদ পিটিয়ে ঢালাই করছেন একদল নারী–পুরুষ। গ্রামগঞ্জে নতুন দালানকোঠা তৈরির সময় নিয়মিতই দেখা যেত এই দৃশ্য। সময়ের সঙ্গে নাই হতে চলেছে সেই ধারা। রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার সাকির শেখ এখনো একটি দল নিয়ে টিকিয়ে রেখেছেন এই গান। হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিলেন সামির আলম

নারী–পুরুষের সমন্বয়ে এভাবে দল গড়ে গানের সুরে এক সময় পাকা বাড়ির ছাদ পেটানোর কাজ করতেন শ্রমিকেরাছবি: কোক স্টুডিও বাংলা

২০ বছরের বেশি ছাদ পেটানোর কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন সাকির শেখ। ৫০ থেকে ৬০ বছর আগে এই কাজে যুক্ত হয়েছিলেন তাঁদের চাচা–ভাইয়েরা। সে সময় আশপাশের আরও অনেকেই এ পেশায় যুক্ত থাকলেও এখন আর তেমন কেউ নেই।

সাকির শেখ জানালেন, এখন তো আর আগের মতো বায়না থাকে না। ভালোবাসার টানেই কাজটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। বায়না থাকলে ছুটে যান। না হলে অন্য কাজে যুক্ত থাকেন।

মনে কিছুটা কষ্ট নিয়েই সাকির বললেন, ‘বাড়ির ছাদ অনুযায়ী আমরা দল গঠন করি। নিয়মিত কাজ না পাওয়ায় দলের অনেককেই এখন পাওয়া যায় না। সবাই কৃষি বা অন্য কাজ করে। আমি নিজেও একটা ভ্যানগাড়ি কিনেছি। ছাদের কাজ না থাকলে ভ্যান চালাই।’

গানে গানে ছাদ পেটানো—যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ইট–সুরকির বাড়ি তৈরিতে এই রীতি চলে আসছে। যেখানে দলনেতাকে অনুসরণ করে বাকিরা গান গাইতে থাকেন। সেই সঙ্গে হাতের কাঠ দিয়ে পিটিয়ে ছাদ মজবুত করেন। রীতিটা অনেকটা এ রকম—গানের প্রথম কলি গাইবেন দলনেতা, পরের অংশ তাঁর সঙ্গে তালে তালে অন্যরা গাইবেন। একই ছন্দে চুন–সুরকির ছাদে পড়তে থাকবে বাড়ি।

ছাদ পেটানোর কাজে গান কেন গুরুত্বপূর্ণ, জানতে চাইলে সাকির বলেন, ‘কাজের সময় দেখা যায় কেউ নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, কারও অন্যদিকে মনোযোগ। এসব কারণে ছাদের কাজে কেউ কেউ পিছিয়ে পড়ে। কাজটা ঠিকমতো হয় না। গানের তালে তালে কাজ করলে সবাই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এতে যেমন দ্রুত কাজ হয়, তেমনি সবার সমান মনোযোগ থাকায় কাজটা ভালো হয়।’

শুরুতে জমিদারদের বাড়িতে এভাবে ছাদের কাজ হতো। তখন সুরকির গুঁড়া ও চুনের মিশ্রণে ছাদ তৈরি হতো। একসময় গ্রামের ধনীরাও এভাবে ছাদ দিয়ে বাড়ি বানাতে শুরু করেন। সেই থেকে গ্রামাঞ্চলেও শুরু হয় ছাদ পেটানোর কাজ। তখন মাসজুড়ে কাজ থাকত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে আধুনিক যন্ত্রপাতি আসায় মেশিন দিয়ে ছাদ ঢালাই করার চলই এখন বেশি। সময়ও লাগে কম। তাই এখন আর কেউ তেমন একটা কাজে ডাকে না। তবে কিছু শৌখিন মানুষ এখনো আছেন, যাঁরা যন্ত্র নয়, মিস্ত্রি ডাকেন ছাদের কাজে।

আরও পড়ুন

সাকির শেখ বলেন, ‘কেউ ডাকলে হাতে একটু সময় নিয়ে কাজ করি। কারণ, কাজের সময় কোন গানগুলো গাইব, সেগুলো কয়েকবার রিহার্সাল করে নিতে হয়। আর দলের বাকিরা দিনমজুরিসহ অন্য কাজ করে, তাদের একসঙ্গে করাটাও কঠিন হয়ে পড়ে।’

ছাদ পেটানোর একটি দলে ৮ থেকে ১২ জন থাকেন। সদস্যদের বেশির ভাগই নারী। এখানেও নেপথ্যে আছে মজুরিবৈষম্য। ‘যে টাকায় চুক্তি হয়, তাতে পুরুষ নিলে সব সময় পোষানো যায় না। নারীদের পারিশ্রমিক দিয়ে পোষানো যায়,’ জানালেন সাকির।

মুক্তি, আশা খাতুনসহ অনেকেই সাকিরের দলে নিয়মিত কাজ করেন। মজুরি কীভাবে নির্ধারিত হয়, জানতে চাইলে সাকির বলেন, ‘ছাদের আকারের ওপর নির্ভর করে। ফুট হিসাবে টাকা। একটা ছাদের কাজ করে হয়তো ১০ হাজার টাকা পেলাম। সেটা আমরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিই। অনেকেই নানা কথা বলে, কেন গান করি, এই পেশা কেন ছাড়ছি না। আসলে দীর্ঘদিনের একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। দেখা যায়, ঘুমের মধ্যেও ছাদ পেটানোর গান গাই।’

দলটি সম্প্রতি কোক স্টুডিও বাংলার ‘মা লো মা’ গানের সঙ্গে পারফর্ম করেছে। ভেবেছিলেন, এরপর হয়তো কাজ বাড়বে। তবে সেই অর্থে বাড়েনি।

এখন তাই অনুষ্ঠানের অপেক্ষায় আছেন। এই সময়ে তাঁদের দলকে কেউ চাইলে গানের দল হিসেবে ডাকতে পারবেন। কারণ, তাঁরা মঞ্চেও পারফর্ম করতে চান। তাঁদের অনেক গান তৈরি আছে। সেই গানগুলো দিয়ে তাঁরা মঞ্চে পারফর্ম করতে চান। দুই সপ্তাহ আগে জানালেই দলবল নিয়ে হাজির হয়ে যাবেন তাঁরা। সাকির শেখকে ফোন করা যাবে ০১৭৯৩২৩৫৭১৫ নম্বরে।

(লেখাটি প্রথম আলোর বিশেষ ম্যাগাজিন বর্ণিল বসত নভেম্বর ২০২৪–এ প্রকাশিত)