আমার চিকিৎসক জীবনে একসঙ্গে এত রোগীর চাপ কোনো দিন সামলাতে হয়নি

১০০ শয্যাবিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালে গত ১৮ ও ১৯ জুলাই আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছিল স্কুল-কলেজপড়ুয়াসহ বিভিন্ন বয়সী তিন শতাধিক মানুষ। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এ এন এম মিজানুর রহমান-এর কাছে ওই দুদিনের অভিজ্ঞতা শুনেছেন প্রণব কুমার দেবনাথ

১০০ শয্যাবিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালের জরুরি বিভাগ
ছবি: প্রথম আলো

নরসিংদী জেলা হাসপাতাল থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ জেলখানা মোড়। সেখানেই গত ১৮ জুলাই দুপুর থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা মোটামুটি প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু এটি যে এত ব্যাপক আকারে সহিংস হয়ে উঠবে, তা ধারণাতেই ছিল না।

বিকেল চারটা থেকে গুলিবিদ্ধসহ আহত কিশোর-তরুণেরা হাসপাতালে আসতে শুরু করে। নাছিমা কাদির মোল্লা হাইস্কুল অ্যান্ড হোমসের নবম শ্রেণি পড়ুয়া তাহমিদের গুলিবিদ্ধ লাশ হাসপাতালে আনার পরই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাকে মৃত ঘোষণা করার পরপরই আবেগপ্রবণ শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। একদিকে তাদের শান্ত রাখা, অন্যদিকে অল্প সময়ের ব্যবধানে একসঙ্গে ২৫-৩০ জন করে আহত কিশোর-তরুণকে চিকিৎসা দেওয়া। সব মিলিয়ে আমাদের হিমশিম দশা হয়েছিল।

আহতদের আনা হয়েছে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালে
ছবি: প্রথম আলো

সাধারণত জরুরি বিভাগে একজন চিকিৎসক সার্বক্ষণিক দায়িত্বে থেকে রোগীদের সেবা দেন। ওই ২ দিনে তাৎক্ষণিকভাবে ৮ জন চিকিৎসক ও ৫০ জন নার্সকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। এ ছাড়া আরও চিকিৎসককে হাসপাতালের কাছাকাছি অবস্থান করে প্রস্তুত থাকতে বলে রাখা হয়েছিল। ওই দুই দিনে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন কমপক্ষে তিন শতাধিক রোগী। তাঁদের অধিকাংশই স্কুল-কলেজপড়ুয়া আন্দোলনরত শিক্ষার্থী। বেশির ভাগই ছররা গুলিতে বিদ্ধ। এ ছাড়া ছিলেন নানা বয়সী পথচারী। তাঁদের মধ্যে ছয়জনকে ভর্তি দিয়েছি, উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছি তিনজনকে। হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের চিকিৎসায় নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন অ্যাম্বুলেন্সচালক, স্থানীয় লোকজন ও ভর্তি থাকা রোগীরা।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে হওয়ায় এই হাসপাতালে এমনিতেও সড়ক দুর্ঘটনা, ট্রেনে কাটা, নানা ধরনের সহিংসতা, টেঁটাযুদ্ধের শিকারসহ বিভিন্ন ধরনের রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। তবে সর্বশেষ কবে রোগীর এমন চাপ দেখেছিলাম, মনে করতে পারছি না। অনেক বছর আগে একবার নরসিংদী রেলস্টেশনে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় হতাহত শত শত রোগী এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। এরপরে আর কখনো এই হাসপাতালে এত রোগীর চাপে পড়েনি।

১৮ জুলাই নরসিংদী জেলা হাসপাতালের জরুরি বিভাগ
ছবি: প্রথম আলো

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৮ জুলাই বিকেলে চিকিৎসা নিতে আসা ৮০ জন ও ১৯ জুলাই বিকেলে চিকিৎসা নিতে আসা ৬১ জন ছিলেন নিবন্ধিত রোগী। এত রোগীর চাপে একপর্যায়ে টিকিট ছাড়াই আমরা চিকিৎসা দেওয়া শুরু করি। ওই দুই দিনে টিকিট না কেটে চিকিৎসা নিয়েছেন কম করেও দেড় শতাধিক রোগী। পরিস্থিতি এমন ছিল, দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা দরকার, টিকিট কাটার মতো সময়ও নেই। এ ছাড়া প্রায় সবাই ছিলেন শিক্ষার্থী, টিকিট কাটার টাকাও হয়তো সবার ছিল না। তখন যদি সব রোগীর নিবন্ধন করতে চাইতাম, তাহলে পরিস্থিতি অন্য রকমও হতে পারত। এমনকি যাঁরা নিবন্ধন করেছেন, ওই ১৪১ জনের কাছ থেকেও আমরা টাকা নিইনি।

আমার ২৪ বছরের চিকিৎসক জীবনে একসঙ্গে এত রোগীর চাপ কোনো দিন সামলাতে হয়নি। কোনো ধারণাও ছিল না, এ আন্দোলনের সহিংসতা এত ব্যাপক মাত্রায় হবে, এত বিপুল সংখ্যার রোগীকে আমাদের চিকিৎসা দিতে হবে। সবার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার চেষ্টা আমরা করেছি। ওই দুই দিনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে আমরাও কিন্তু খুব অনিরাপদ ছিলাম।

করোনা মহামারিতেও আমরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছি, এত এত মৃত্যু দেখে আমরা অভ্যস্ত, কিন্তু ওই দুই দিনের ঘটনা একেবারেই আলাদা। স্কুল-কলেজের অল্প বয়সী শিক্ষার্থীরা হাতে, পায়ে, বুকে, মাথায়, চোখে ছররা গুলিতে আহত হয়ে আমাদের কাছে চিকিৎসার জন্য এসেছে, কেউ কাতরাচ্ছে-আহাজারি করছে। এত ছোট শিশুদের এভাবে দেখে আমরা অভ্যস্ত নই।

সঙ্গে থাকা শিক্ষার্থীরাও আহত ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় জানাতে পারছিলেন না। অনেক শিক্ষার্থীর পরনেই ছিল স্কুল-কলেজের ড্রেস। হাসপাতালে ছুটে আসছিলেন অনেক শিক্ষক-অভিভাবক। ওই সময়ে তাঁদের কষ্ট, আহাজারি, উত্তেজনা আমাদের স্পর্শ করেছে। মনের ভেতরে এসব দৃশ্য বহুদিন বয়ে বেড়াতে হবে। ওই দুই দিন দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকবে। এমন পরিস্থিতি আর কোনো দিন না আসুক।