দুই মেয়েকে দেশসেরা টেবিল টেনিস খেলোয়াড় বানিয়েছেন এই বাবা

বাবা শেখ আব্দুর রহমানের সঙ্গে দুই কন্যা জোবেরা রহমান লিনু (বাঁয়ে) ও মুনিরা রহমান হেলেন
ছবি: লেখকের সৌজন্যে, পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

করোনার মধ্যে একদিন, ভালুকায়, আমাদের ফ্যাক্টরিতে ফাঁকা একটা ইজি চেয়ারের দিকে তাকিয়ে বুকটা হু হু করে ওঠে। আব্বার কথা মনে পড়ে যায়। শৈশবে কাপ্তাইয়ের বাসায় এই চেয়ারেই বসতেন আব্বা। একবারই ভালুকায় এসেছিলেন আব্বা। এসে প্রথমে এই ইজি চেয়ারে বসেছিলেন।

সেসব কথা মনে করেই চেয়ারটার কাছে গিয়ে হাত বুলিয়ে বাবার স্পর্শ পাওয়ার চেষ্টা করলাম। মাঠের মধ্যে বসে সামনের পুকুরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন বাবা। জানি না আব্বার মনের মধ্যে তখন কী ভাবনা ঘুরছিল।

এসব ভাবতে ভাবতে শৈশবের কাপ্তাইয়ে চলে গেলাম। আমার আব্বা শেখ আবদুর রহমানের ইচ্ছা ছিল, আমি যেন ভালো কিছু করি। আমাকে বলাই ছিল, আমি যেন প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পর বিকেলের নাশতা সেরে খেলার পোশাক পরে বাসার পেছনের মাঠে যাই। আমার জন্য সেখানে হাই জাম্প, লং জাম্প খেলার জায়গা তৈরি করে রেখেছিলেন আব্বা। সেখানে গিয়ে সহপাঠী মীরা, আমার মামাসহ আরও অনেকের সঙ্গে অনুশীলন করতাম। আব্বা অফিস থেকে ফিরেই হয়ে যেতেন প্রশিক্ষক। আমি একটু ভালো করলে আব্বার সে কী আনন্দ! সেই ১৯৬৭-৬৮ সালে ফ্রান্স থেকে আমার জন্য ২টি স্টপওয়াচ ও একটা বাদামি রঙের মেজারিং টেপ আনিয়েছিলেন আব্বা। সেই সময়ে ‘ব্লক’ করে আমাকে স্কুলের মাঠে ১০০ মিটার দৌড় প্র্যাকটিস করাতেন। পায়ের জোর বাড়ানোর জন্য স্পিলওয়ের অপর পাড়ে বালুর মাঠে নিয়ে যেতেন। দৌড়ের পর আব্বা সব সময় আমার পা ম্যাসাজ করে দিতেন।

আমার বয়স তখন ১১ বছর। স্কুলের শিক্ষকেরা সবাই আমাকে খুব আদর করতেন। কারণ, আমার জন্য চট্টগ্রাম বিভাগ সেই সময়ে চ্যাম্পিয়ন হতো। সবাই জানত, কাপ্তাই স্কুলের ছোট্ট একটা মেয়ে চারটি ইভেন্টে সব সময় প্রথম হয়। আমাকে চট্টগ্রাম বিভাগের সবাই ‘বলাকা’ বলে জানত। কারণ, তখন ‘বলাকা’ ট্রেন ছিল সবচেয়ে দ্রুতগামী। আব্বার ইচ্ছা ছিল আমাকে শুটিং শেখাবেন। আমাদের বাসার পেছনে টিলার গায়ে টার্গেট প্র্যাকটিস করার জন্য একটা বোর্ডে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গোল গোল করে কালো রঙের বৃত্ত করা ছিল। আব্বা শেখাতনে কীভাবে তাক করব টার্গেটে।

বাবার অনুপ্রেরণায় টেবিল টেনিসে এসে দেশসেরা হয়েছিলেন হেলেন ও লিনু
কোলাজ: লেখকের সৌজন্যে

মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। ১৯৬৯ সালে আমি রাঙামাটিতে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়েছিলাম। কাপ্তাই থেকে রাঙামাটি যাওয়ার জন্য আব্বার প্রজেক্টের লঞ্চ ছিল। দোতলা লঞ্চ, খুব সুন্দর। তাতে করে আম্মা-আব্বাসহ কর্ণফুলী লেক দিয়ে রাঙামাটি গেলাম। জেলা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আরম্ভ হওয়ার সময় আমার হাতে সব সময় মার্চপাস্টের পতাকা থাকত। সবাই ভাবত, ট্র্যাকস্যুট পরা মেয়ে নিশ্চয় খুব স্মার্ট হবে। তখন পর্যন্ত কোনো খেলায় আমি দ্বিতীয় হইনি। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ানশিপে বড় বড় মেয়েদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। সেই সময় মেয়েদের প্রতিযোগিতায় কোনো সিনিয়র-জুনিয়র বিভাগ ছিল না।

কাপ্তাই থেকে ১৯৭০ সালে সিলেটের শাহজিবাজারে বদলি হয়ে আসার পরও আব্বা আমার প্র্যাকটিসের জায়গা তৈরি করা শুরু করলেন। কয়েক দিনের মধ্যেই আবার শুরু হলো প্রশিক্ষণ। এর মধ্যে হঠাৎ যেন আমি বড় হয়ে যাই। আগের মতো ফ্রি হতে পারি না। নিজের মধ্যে কেমন লজ্জা লজ্জা একটি ভাব। শর্টস পরতে চাইতাম না। ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই চারদিকে দমবন্ধ একটা অবস্থা। তারপর তো মুক্তিযুদ্ধই শুরু হয়ে গেল। দাবা ছাড়া বসে বসে খেলার কিছুই পছন্দ করতেন না আব্বা। কাপ্তাই থাকতে টেবিল টেনিস খেলা শিখেছিলেন। নতুন জায়গায় এসে আর জুতসই খেলার সাথি পান না। এর মধ্যে আমাকে দু-একবার খেলতে নিয়ে গিয়ে দেখলেন, আমার ফুটওয়ার্ক খুব ভালো। এটা টেবিল টেনিসের জন্য ভীষণ জরুরি। এভাবেই টেবিল টেনিসে আমার যাত্রা শুরু। এইভাবে কিছুদিন খেলার পর আব্বাকে যখন হারাতে আরম্ভ করলাম, তাঁর মধ্যে একটা আস্থা জন্মাল, আমি নিশ্চয় পারব।

১৯৭৩ সালে প্রথম বাংলাদেশে ওপেন টু অল টুর্নামেন্ট শুরু হলে সিলেট থেকে আমার নাম পাঠালেন আব্বা। আমার জীবনের মোড় ঘুরে আউটডোর থেকে ইনডোর হয়ে গেল। সেই সময় সদ্য স্বাধীন দেশে যে খেলাগুলো সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল, তার মধ্যে টেবিল টেনিস একটি। আগে বলা হতো পিংপং খেলা। বাংলাদেশের প্রথম নারী টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়ন হলাম। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের হাত থেকে পদক নিয়েছিলাম। এক এক করে খেলে যেতে থাকলাম। চ্যাম্পিয়ন হলাম। আমার পর আমার ছোট বোন জোবেরা রহমান লিনু ১৬ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে রেকর্ড করল। আমার আব্বার আশা কিছুটা হলেও পূরণ হলো। আমার সেই আব্বা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। ২০১৮ সালে আব্বা মারা গেছেন।

ভালুকায় দাঁড়িয়ে দেখছি, পুকুরের একদিকে সারি সারি তালগাছ। গাছগুলোর মাঝখান দিয়ে আকাশে লাল আবির ছড়িয়ে ডুবে যাচ্ছে সূর্য। চারদিক কেমন চুপচাপ হয়ে আসছে। আর এই প্রকৃতির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি এক টাইম মেশিনে চড়ে যেন আব্বার সঙ্গে ঘুরে এলাম আমার পুরো জীবনের ওপর দিয়ে।

লেখক: জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার ২০১৩ প্রাপ্ত খেলোয়াড় ও বাংলাদেশ জাতীয় টেবিল টেনিস ফেডারেশনের সহসভাপতি