অনেক চাকরির জন্যই আসলে চার বছরের ডিগ্রি লাগে না

জেনি রোমিটি ছিলেন বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান আইবিএমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। গত বছর মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের লয়োলা ম্যারিমাউন্ট ইউনিভার্সিটিতে সমাবর্তন বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। পড়ুন নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।

জেনি রোমিটির ফেসবুক থেকে নেওয়া
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

আজ এই স্বল্প সময়ে আমার জীবনের তিনটি গল্প তোমাদের শোনাতে চাই। তিনটি গল্পই একসূত্রে গাঁথা। আর তা হলো ‘ইতিবাচক শক্তি’।

প্রথম গল্প

বড় হয়েছি শিকাগো শহরতলির একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে। তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে আমি ছিলাম বড়। খুব বেশি টাকাপয়সা ছিল না। তবে যেহেতু আশপাশে আমাদের মতো আরও অনেকেই ছিল, আমরা আমাদের দারিদ্র্য টের পাইনি। কিন্তু একদিন হঠাৎই মাকে ছেড়ে বাবা চলে গেলেন। এই এক ঘটনায় বদলে গেল সব।

শুধু মাকে নয়, বাবা আমাদের সবাইকেই ছেড়ে গিয়েছিলেন। কোনো টাকাপয়সা দেননি, কখনো ফিরেও আসেননি। ভাবতে পারো? মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আমার হাইস্কুল পাস মাকে চার সন্তানসহ পথে নেমে আসতে হলো। না ছিল টাকা, না ছিল ঘর, না কাজের অভিজ্ঞতা। মা নিশ্চয়ই ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের কখনোই বুঝতে দেননি। আমাদের মাথার ওপর থেকে কখনো ছাদ সরে যায়নি, আমরা কখনো না খেয়ে থাকিনি, কখনো আমাদের স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়নি।

মা শুরুতে খণ্ডকালীন কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু বুঝতে পারছিলেন, চার সন্তানকে বড় করতে হলে তাঁর একটা ভালো চাকরি দরকার। আর সে জন্য চাই দক্ষতা। অতএব কাজের পাশাপাশি মা একটি কমিউনিটি কলেজে ভর্তি হয়ে যান। একটু একটু করে দক্ষতা অর্জন করেন। আর একসময় হয়ে যান একটি অফিসের ব্যবস্থাপক। পরে তিনি ক্লিনিকেও কাজ করেছেন। মা কখনোই চাননি বাবার কর্মকাণ্ডের ফল আমাদের কারও ভবিষ্যতের ওপর পড়ুক। কথা দিয়ে নয়, মা কাজ দিয়েই বুঝিয়েছেন—যখন তোমার সামর্থ্য খুব কম, তখনো তুমি চাইলে নিজের পরিচয় নির্ধারণ করতে পারো। জীবনে এমন অনেক সময় আসবে, যখন তোমার পরিচয় অন্য কেউ ঠিক করে দিতে চাইবে। এটা হতে দিয়ো না।

দ্বিতীয় গল্প

তখন আমি একজন তরুণ নির্বাহী। আমার সিনিয়র যিনি ছিলেন, তিনি হঠাৎই ডেকে একটি সুখবর দিলেন। তাঁর পদোন্নতি হবে। অতএব তিনি চান তাঁর পদটি যেন আমি নিই। সে জন্য স্রেফ একটি আনুষ্ঠানিক ইন্টারভিউ দিলেই হবে। স্পষ্ট মনে আছে, আমি বলেছিলাম, ‘না।’ কারণ মনে হয়েছিল, আমার আরও অনেক কিছু শেখার আছে। আরও একটু সময় আর অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। তিনি বলেছিলেন, ‘আগে যাও তো। ইন্টারভিউটা দাও।’

দিলাম। টিকেও গেলাম। কিন্তু বললাম, ‘সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমি বাড়ি ফিরে আমার স্বামী মার্কের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ তো সব শুনে মার্ক বলল, ‘আমি তোমাকে চিনি জেনি। আমার মনে হয়, ছয় মাস পর তুমি এর চেয়েও ভালো কোনো প্রস্তাবের যোগ্য হয়ে যাবে।’

পরদিন অফিসে গিয়ে যখন বললাম, আমি রাজি আছি; বস আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘এ রকমটা আর কোনো দিন কোরো না।’ এ ঘটনা আমার জীবনে একটা বড় শিক্ষা। আর সেই শিক্ষা হলো, উন্নতি আর স্বস্তি কখনো একসঙ্গে থাকে না। কারণ, বড় হতে হলে ঝুঁকি নিতে হয়। আর ঝুঁকি সব সময় তোমাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলবে। কিন্তু এই অস্বস্তিটা দরকার। এই অস্বস্তির মানে হলো, তুমি কিছু শিখতে যাচ্ছ। আমি বলব, ঝুঁকির উল্টো পিঠে উন্নতিটাও দেখো। প্রশ্ন করো। কৌতূহলী হও। যত পারো শেখো। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন শেখার যে অভ্যাস গড়ে তুলেছ, সেই অভ্যাস এখানে ফেলে যেয়ো না; বরং সঙ্গে নিয়ো।

শেষ গল্প

২০১২ সালে যখন প্রথম আইবিএমের প্রধান নির্বাহী হলাম, তখন প্রযুক্তি খাতে বড় বড় পরিবর্তন আসছিল। এখন হয়তো তোমাদের কাছে এসব প্রযুক্তির অনেক কিছুই খুব সাধারণ মনে হয়, কিন্তু তখন সেগুলোই ছিল বড় ব্যাপার। যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ক্লাউড ও সাইবার সিকিউরিটি। তো এই নতুন নতুন পরিবর্তনের জন্য আমাদের প্রচুর নতুন লোক দরকার ছিল। কিন্তু আমরা কোনো লোক পাচ্ছিলাম না। দেখা গেল, যোগ্য লোকের অভাবে শত শত পদ খালি পড়ে আছে। অনেকে বলছিল, যোগ্য চাকরিপ্রার্থীই নেই, আমরা চাকরি দেব কাকে! অথচ সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারের হার ছিল অনেক বেশি। সংখ্যাটা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ। যাদের মধ্যে একটা বড় অংশই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। খুব অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এটি কীভাবে সম্ভব? এতগুলো চাকরির সুযোগ খুলে বসে আছি, অথচ নেওয়ার কেউ নেই!

আমি গভীরভাবে ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করতে শুরু করলাম। দুঃখজনকভাবে সে সময় আমার বিশ্লেষণ থেকে যা পেয়েছিলাম, তা আজও অনেকখানি সত্য। প্রথমত, আইবিএমের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কেন যেন প্রথাগত চার বছরের ডিগ্রিধারীদের মধ্যেই চাকরিপ্রার্থী খোঁজে। প্রতিটি চাকরির জন্যই তারা স্নাতক, নয়তো পিএইচডি ডিগ্রি চায়। দ্বিতীয়ত, অনেক চাকরির জন্যই আসলে চার বছরের ডিগ্রি লাগে না। তৃতীয়ত, ৬৫ শতাংশ মানুষের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিই নেই। আমি যেই উপাত্তটা দিলাম, এটা যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু অধিকাংশ উন্নত দেশের ক্ষেত্রেই এটি সত্য। এটি খুবই দুঃখজনক যে বিশাল একটা কর্মশক্তি আমরা কোনো কাজে লাগাতে পারছি না, শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেই বলে।

তখন থেকে আমরা আইবিএমে একটা বড় পরিবর্তন আনি। কলেজ, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো থেকে চাকরিপ্রার্থী খুঁজতে শুরু করি। চাকরি দেওয়ার সময় আমরা শুধু যোগ্যতা আর দক্ষতাই দেখতাম, ডিগ্রি নয়। এর মাধ্যমে দারুণ ফলও পেয়েছি। দারুণ মেধাবী সব মানুষ আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। আমাদের কর্মশক্তিতে বৈচিত্র্য যোগ হয়েছে। তাই তোমাদের প্রতি অনুরোধ, সব সময় যোগ্যতা আর দক্ষতা দিয়েই মানুষকে বিচার কোরো। অন্যের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়ো।

ইংরেজি থেকে অনুদিত