‘বিশাল বিপ্লব সামনে আসছে, আমাদের রেডি থাকতে হবে’

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এ বি এম শওকত আলী। দেশে–বিদেশে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। কম্পিউটারবিজ্ঞানী হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি আছে। মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতেই আমরা তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহিদ হোসাইন খান

প্রথম আলো:

মেশিন লার্নিং, ডেটা সায়েন্স বা এআইয়ের ক্ষেত্রে পৃথিবী যেভাবে এগোচ্ছে, সেদিক থেকে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে আছি। আপনি বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন?

আমি মনে করি, আমরা মোটেও পিছিয়ে নেই; বরং ঠিক সময়ে, ঠিকভাবে শুরু করেছি। শুধু স্পিরিটটা ধরে রাখতে হবে। যে দেশে প্রযুক্তি আছে, সেখানে নতুন প্রযুক্তি প্রবেশ করা কঠিন। সেখানকার সরকার, প্রতিষ্ঠান, সবাই চিন্তা করে এত টাকা দিয়ে তৈরি করা প্রযুক্তি কি ফেলে দেব? সেখানে কিছুটা কনজারভেটিভনেস (গোঁড়ামি) কাজ করে। বাংলাদেশ কিন্তু এই দিক থেকে ফ্রেশ। আমাদের কোনো বিনিয়োগ নেই, আমরা একেবারেই নবীন। এখানে নতুন প্রযুক্তি শুধু নিয়ে এলেই হলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা উক্তি আছে—তোমার নিজের সময় দিয়ে সন্তানের সময় বেঁধে দিয়ো না। আমার তো সেই দুঃসাহস নেই। আমি দেখছি, আমাদের ছেলেমেয়েরা অবিশ্বাস্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আইসিটি অলিম্পিয়াডের আয়োজক ছিল। মাদ্রাসা থেকেও সেখানে শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছে। আমরা এর আগে এআই অলিম্পিয়াড করেছি, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীসহ অনেকেই অংশ নিয়েছে। তাদের বোঝাপড়া আমি অবাক হয়ে শুনেছি। তাই আমি বলব, আমরা মোটেই পিছিয়ে নেই। আমাদের সবাই কাজের জন্য রেডি, সেখানে বাধা কোনো বিষয় নয়।

প্রথম আলো:

এআইয়ের কারণে অনেক চাকরি হারিয়ে যাবে, কাজের সুযোগ কমে যাবে, এমনটা অনেকে বলে। ভীত না হয়ে বরং সুযোগগুলো আমরা কীভাবে কাজে লাগাতে পারি?

এ ধরনের সমস্যা আগেও ছিল। যখন টাইপরাইটার প্রথম আসে, তখনো বলা হয়েছিল কেরানিদের চাকরি থাকবে না। আসলে কি তা–ই? টাইপরাইটার থেকে এখন কম্পিউটার চলে এসেছে। মানুষের কাজের পরিধি কি কমেছে? বরং বেড়েছে। এআই কোনো কিছুর বিকল্প হিসেবে এসেছে তা নয়; বরং এআই আসছে সহযোগী হিসেবে। এটা কাজের গতি বাড়িয়ে দেবে। ১০০ থেকে ১৫০ বছরে কর্মক্ষেত্রে যে কাজ হতো, এআইয়ের সহায়তায় হয়তো সেটা ৫০ বছরে হয়ে যাবে। এআই আমাদের সামনে অবিশ্বাস্য সব সুযোগ উন্মোচন করে দেবে। অতএব আমি মনে করি না, এআই কাজ কমিয়ে দেবে। যে বিষয়েই পড়ি না কেন বা কাজ করি না কেন, সেখানে এআই কাজে আসবে। আপনি মেডিকেলে পড়েন বা নাবিক হন, সবখানেই এআইয়ের বৈপ্লবিক ব্যবহারের সুযোগ আছে।

আরও পড়ুন
কম্পিউটারবিজ্ঞানী হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি আছে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
প্রথম আলো:

আপনি বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ‍্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, গবেষণা করেছেন। এআই নিয়ে যখন আপনারা প্রাথমিকভাবে আলাপ করতেন, গবেষণার সুযোগ খুঁজতেন, তখন কি ভাবতে পেরেছিলেন, পরিবর্তনগুলো এত দ্রুত হবে?

আমি যখন এআই নিয়ে গবেষণা করেছি, তখন এসব ছিল শুধু পড়াশোনার বিষয়। ব্যবহারের কিছু ছিল না। এখন যেমন চ্যাটজিপিটির মতো ব্যবহারিক টুলস দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হয়, ভবিষ্যতে এআই সবাই ব্যবহার করবে। রিকশাচালকেরাও এআই ব্যবহার করে জানতে চাইবেন, যাত্রীর কাছ থেকে কত ভাড়া নিতে হবে!

প্রথম আলো:

আপনাকে যদি ১০ বছর পরের পৃথিবীটা কল্পনা করতে বলা হয়, কী দেখতে পান?

এটা বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। অল্প সময়ে বলা যাবে না। আইনস্টাইনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেমন হবে? তিনি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে বলেননি, বলেছেন চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের কথা—সেই যুদ্ধ হবে দা–কুড়াল নিয়ে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে এত ক্ষতি হবে যে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের সময় মানুষ আর দাঁড়াতে পারবে না। এ প্রশ্নটা এমনই। আমাদের সামনে আসছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এই কম্পিউটার ইতিহাস বদলে দেবে। এখন প্রযুক্তির দুনিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার যখন আসবে, তখন সব সিকিউরিটি সিস্টেম বদলে যাবে। তখন আমরা আরও দক্ষ হব। কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করে জিনোম তত্ত্বের অনেক কিছু বলে দিতে পারব। কোন রোগ হবে, শরীরের কী অবস্থা, সব। একটা মুদ্রা হাতে নিয়ে টস করার সময় আমরা হেড অথবা টেল কল্পনা করি। কোয়ান্টাম কম্পিউটারে এমন থাকবে না। কোয়ান্টাম কম্পিউটার হেড ও টেল দুটিই গণনা করতে পারবে। আধুনিক কম্পিউটার চলছে বৈদ্যুতিক শক্তি ও গতিতে, আর কোয়ান্টাম কম্পিউটার চলবে আলোর গতিতে। অতএব বিশাল বিপ্লব সামনে আসছে, আমাদের রেডি থাকতে হবে। সামনের দুনিয়ায় যুদ্ধের ধরন বদলে যাবে। তখন যুদ্ধ হবে প্রযুক্তি দিয়ে। ড্রোন ও রোবট দিয়ে যুদ্ধ হবে। এআই হবে তখন বড় শক্তি। যুদ্ধের সময় এসবের অনেক ব্যবহার হবে। লক্ষ করলে দেখবেন, পাশের দুই দেশ প্রযুক্তি দিয়ে যুদ্ধ করছে। এখন বিদেশ গেলে আমরা পাসপোর্ট হারানো নিয়ে দুশ্চিন্তা করি। সামনের দুনিয়ায় টিকার মতো করে এআই প্রসেসরও শরীরের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হবে। তখন মানুষ কোথায় যাচ্ছে, সব জানা যাবে কম্পিউটারে। পাসপোর্ট লাগবে না। নিউইয়র্ক বা মহাকাশ, যেখানেই যান না কেন, যেকোনো সময় জানা যাবে। এআই প্রসেসর তখন মানুষকে গাইড করবে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

আপনার জীবনের এমন কোনো ঘটনা বা গল্প কি বলবেন, যা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিকসে অনার্স করি। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে সিএসইতে মাস্টার্স করি। ১৯৮৮–৮৯ সালের কথা, তখন পুরোনো ম্যাগাজিনের দোকান থেকে রিডার্স ডাইজেস্ট কিনতাম। সোহরাওয়ার্দী হলের ৪৩০ নম্বর রুমে থাকতাম। একদিন দুপুরবেলা পুরোনো রিডার্স ডাইজেস্ট পড়ছি। জার্মান কোম্পানি সিমেন্সের একটা প্রতিবেদন চোখে পড়ল। সেখানে স্মার্ট ফ্রিজের কথা বলা হয়েছিল। ফ্রিজ নাকি ভবিষ্যতে নিজে নিজে গ্রাহকের কী কী খাবার খাওয়া প্রয়োজন, বুঝতে পারবে। ফ্রিজ নিজেই বাজার থেকে অর্ডারের পর পেমেন্ট করে দেবে। সেই লেখা পড়ে আমি চমকে গিয়েছিলাম। এখন সেই কাজই দেখছি। এমন বিস্ময় আর কৌতূহল নিজের জীবনে ধারণ করেছিলাম বলেই অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে এআই ও মেশিন লার্নিংয়ে পিএইচডি করেছি। নতুন এআই মডেল নিয়ে আমি যে গবেষণা করেছিলাম, সেটা অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম।

দেশে–বিদেশে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন তিনি
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
প্রথম আলো:

দায়িত্ব নেওয়ার পর বিইউবিটির কোন দিকটিতে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে চাইছেন?

আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন গবেষণা ভালোবাসে, আমি সেটাই করতে চাই। একজন সাধারণ মানুষ কলম কেনে। আর গবেষকেরা কেনার আগে প্রশ্ন করেন—কলমে কী কালি আছে, কতটা ব্যবহার করা যাবে। প্রশ্নের মাধ্যমে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন। আমাদের দেশের মেয়েরা বিদেশে কাজ করতে যায়। আবার অনেকেই বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়। আমার একটা লক্ষ্য হলো—নার্সিং বিষয়ে পড়াশোনা চালু করতে চাই। নার্সদের প্রযুক্তি ও ভাষা শেখাতে চাই। পশ্চিমা দেশে নার্স হিসেবে আমাদের নারীদের কাজের সুযোগ আছে। নারীদের মধ্যে আমি যোগাযোগের দক্ষতা ও প্রযুক্তি ব্যবহার দেখতে চাই। চীনারা ইংরেজি পারে না, অ্যাপ দিয়ে সব করছে। আমাদের হাতে শুধু প্রযুক্তি তুলে দিতে হবে। দক্ষতা বাড়ালে নারীদের কর্মসংস্থান বাড়বে বলে আমি মনে করি।

প্রথম আলো:

বিইউবিটিতে আপনার সবচেয়ে বড় চ‍্যালেঞ্জ কোনটা? আর সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গাই–বা কোনটা?

উপাচার্য হিসেবে বিইউবিটিতে আমার হাতে চার বছর সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে আমি বিইউবিটিকে একটি অবস্থানের মধ্যে রেখে যেতে চাই। আকাশচুম্বী কোনো বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়তো পরিণত করতে পারব না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ওপরের দিকের একটা স্থানে পৌঁছে দিতে চাই। আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন বিদেশে আরও বেশি স্বীকৃতি পায়, পরিচিতি বাড়ে, সেই লক্ষ্যে কাজ করতে চাই। আমাদের শিক্ষকেরা অনেক তরুণ, তাঁদের শক্তি কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। শিক্ষার্থীরা অনেক চমকে দেওয়ার মতো কাজ করছে। আজ আমার সঙ্গে দুটি দলের আলাপ হলো। একদল শিক্ষার্থী মৎস্য চাষে এআইয়ের মাধ্যমে পানি পরিষ্কারের টুল তৈরি করে একটি প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছে। আরেক দল আরেক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে ৫০ হাজার টাকার পুরস্কার পেয়েছে। এমন করে প্রতিদিনই আমাদের শিক্ষার্থীরা আমার দিনকে আলোকিত করছে। আমার শিক্ষার্থীরা যে মানে ভর্তি হচ্ছে, আমি তাদের মান উন্নয়নের পরিবেশ তৈরি করতে চাই। রাষ্ট্রের কাছে আমরা সরাসরি অনেক কিছু চাইতে পারি না। আমার প্রত্যাশা থাকবে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বড় বড় কোম্পানিগুলো গবেষণায় বিনিয়োগ করুক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আমাদের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স নেওয়া হচ্ছে। এই অর্থ গবেষণায় ব্যবহারের সুযোগ দিলে আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়বে। সমাজের প্রতি আমাদের যে দায়বদ্ধতা আছে, তা পরিশোধে আমরা সবাই যেন এগিয়ে আসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য হাত বাড়াতে হবে। আমরা যদি শিল্পনির্ভর দেশ হতে পারি, তাহলে আমাদের আর বিশ্বব্যাংকের অর্থের জন্য বসে থাকতে হবে না।