আরাঁর গণি চার পোপাতে ধনী

পোপা মাছ হরহামেশা ধরা পড়ে না। তবে একবার জালে জড়াতে পারলেই লাখপতি! সেই মাছই তিনবার পেয়েছেন সেন্ট মার্টিনের জেলে আবদুল গণি। সর্বশেষ পেলেন ৮ নভেম্বর। তাঁর অভিজ্ঞতা শুনেছেন গিয়াস উদ্দিন

আবদুল গণির হাসিতে ফুটে উঠছে পোপা মাছ পাওয়ার আনন্দ
ছবি: প্রথম আলো

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর। দিন–তারিখ সঠিক মনে নেই। প্রতিদিনের মতো জাল নিয়ে সাগরে গেছি। সেন্ট মার্টিন থেকে ট্রলারে ২০ মিনিটের দূরত্ব। সন্ধ্যা নামার আগেই জাল ফেলে তিন সহযোগী নিয়ে ফিরে আসি ঘাটে। এটাই আমাদের প্রতিদিনের জীবন। সন্ধ্যার মধ্যে জাল ফেলা, ফজরের সময় গিয়ে তুলে নিয়ে আসা। জালে কোরাল, সুরমার মতো বড় মাছই বেশি ধরা পড়ে।

সেপ্টেম্বরের সেদিনও জাল তুলে দেখি বড় বড় মাছ উঠেছে। একটা মাছে আমার চোখ আটকে যায়। এই মাছটা আমার চেনা—পোপা। এই মাছের কত গল্পই না ছোটবেলা থেকে শুনেছি। মুরুব্বিরা বলত, একবার ধরতে পারলেই ধনী। লাখ টাকা দাম। পরিচিত কে কবে পেয়েছে, সেসব গল্পও করত। কিন্তু আমার জালে কখনো পোপা ধরা পড়বে, স্বপ্নেও ভাবিনি। ২০১০ একবার ছোট একটা পোপা মাছ দেখেছিলাম। মাছটা আমি তখন থেকেই চিনি। এবারেরটা অনেক বড়।

 মাছ নিয়ে দ্রুত ফিশারিঘাটে ফিরে আসি। পোপা মাছ ধরা পড়ার খবর ততক্ষণে ঘাটে রটে গেছে। মাপা হলো, ওজন ৩৪ কেজি ৯০০ গ্রাম। সবাই জানে দামি মাছ। কিন্তু কত দাম? কেউ বলতে পারে না। দেরি না করে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দিলাম। কয়েক ঘণ্টা পর কক্সবাজারের মাছের আড়তে পৌঁছালাম। কয়েকজন ব্যবসায়ীর দরাদরিতে দাম উঠল ৮ লাখ টাকা। একটা মাছের দাম এত টাকা হতে পারে, বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। বিক্রি করে দিলাম। আমার সহযোগী জেলেরাও খুশি। ওরাও দামের একটা অংশ পেল। যে মাছটি কিনল, তখনই সে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছুটল। শুনেছি, সেখানে আরও বেশি দামে এটা বিক্রি হয়। আকার বড় থাকলে ১৫ লাখ টাকাতেও বিক্রি হয়।

প্রথম মাছ বিক্রির সেই টাকায় বাঁশ, বেড়া ও পলিথিনের ছাউনির ঘর ভেঙে দুই রুমের বিল্ডিং দিলাম। পাশাপাশি আরও কিছু মাছ ধরার জাল কিনলাম।

পোপা মাছ

পোপা মাছ

পোপা মাছের বৈজ্ঞানিক নাম মিকটেরোপারকা বোনাসি (Mycteroperca bonaci)। মাছটি ‘কালা পোপা’ নামেও পরিচিত। পোপা মাছের বায়ুথলি (এয়ার ব্লাডার) দিয়ে তৈরি হয় বিশেষ ধরনের সার্জিক্যাল সুতা। এ কারণে মাছটির দাম অনেক। পোপার একটি প্রজাতি পশ্চিম আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর–পূর্ব যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রাজিল পর্যন্ত পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) তালিকায় পোপা বিপন্ন প্রজাতির মাছ।

আবারও পোপা

তারপর প্রায়ই মনে হতো আজকে আবার জালে  পোপা ধরা পড়বে। সেই দিনটি এল দুই বছর পর—২০২০ সালে। সেবার ছিল সেপ্টেম্বর মাস, এবার নভেম্বর। আবারও জালে ধরা পড়ল একটি পোপা, ওজন ২৮ কেজি। বিক্রি হলো সাড়ে ৫ লাখে। মাছ বিক্রির টাকায় নতুন করে আরও একটি ইঞ্জিনের নৌকা তৈরি করলাম। আমার এখন দুইটা নৌকা। সাতজন লোক আমার সঙ্গে কাজ করে।

চাইলেই পোপা মাছ ধরা যায় না, কপাল লাগে, এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য, মৌসুমের একটা ব্যাপার আছে। বছরের সব সময় মাছটা ধরা পড়ে না, দীর্ঘদিনের মাছ ধরার অভিজ্ঞতায় এটুকু বুঝি। এবারও যেমন ৮ নভেম্বর দুটি পোপা মাছ পেয়েছি। তবে মা মাছ বলে এবার দাম একটু কম পেয়েছি। পৌনে তিন লাখ টাকা। আমার মতো আর কোনো জেলে তিনবারে চারটা পোপা ধরতে পারেনি। তাই সেন্ট মার্টিনের মানুষ নাকি এখন বলাবলি করে, ‘আরাঁর গণি চার পোপাতে ধনী।’