প্রথম দর্শনে মনে হয় রাতের আকাশ। কিন্তু ছবিটি রাতের আকাশের না। ছিল ১৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০০ কোটি বছর আগের মহাবিশ্বের একটি ছবি। ২০২২ সালের ১২ জুলাই প্রকাশের পর থেকেই ছবিটি নিয়ে সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যায়। ছবিটা তুলেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি)। দিনের আলো গড়াতে গড়াতে আমরা জেনে যাই, ছবিটি তুলেছে প্রকল্পের কানাডীয় গবেষক দল। আর সেই দলেরই অন্যতম গবেষক ঢাকার শান্তিনগরে বেড়ে ওঠা লামীয়া আশরাফ মাওলা।
কোন লামীয়া? ছোটবেলায় যিনি কিনা দেখতেন অর্থনীতির শিক্ষক বাবা ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন তুলছেন আর সেগুলোর উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। একটু বড় হয়ে লামীয়া জানতে পারেন, এই কাজের নাম ‘গবেষণা’। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় তাঁর সামনে এক নতুন জগতের দরজা খুলে দিলেন লামীয়ার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক আরিফুর রহমান। লামীয়া আশ্চর্য হয়ে দেখেন, কোন কোন ফলের শরবতের মধ্যে কাগজের রং পাল্টে যায়। তারপর থেকে নির্ধারিত সময়ের বাইরেও ওই ল্যাবরেটরিতে পড়ে থাকেন লামীয়া। আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় অসীম আকাশেরই প্রেমে পড়ে গেলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কোথায় পড়া যায়, তার খোঁজখবর করা শুরু হলো। তারপর পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রে, ভর্তি হন ওয়েলেসলি কলেজে। সেখানে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়েন। পরে ডক্টরাল গবেষণা করেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
লামীয়ার কাছ থেকে জানা গেল, সেখানেই হাবল টেলিস্কোপ নিয়ে কাজ করেন। তখনই হাবলের উত্তরসূরি জেমস ওয়েব নিয়ে কাজ শুরু হয়ে গেছে। ভাবছিলেন, কেমন করে এই স্পেস টেলিস্কোপে কাজ করা যায়। জেডব্লিউএসটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি প্রকল্প। এর সঙ্গে যুক্ত আছে যুক্তরাষ্ট্রের নাসা, কানাডা স্পেস এজেন্সি এবং ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসা)। প্রকল্পটির ব্যয় প্রায় ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) মার্কিন ডলার। মহাবিশ্ব শুরু হওয়ার কয়েক শ মিলিয়ন বছর পর প্রথম যে গ্যালাক্সিগুলো গঠিত হয়েছে, সেগুলোর ছবি তোলার জন্য এই টেলিস্কোপ তৈরি করা হয়েছে। এটি পৃথিবী থেকে দেড় মিলিয়ন (১৫ লাখ) কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে।
পিএইচডি শেষ করে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাকাশ গবেষণা দলে কাজের সুযোগ পান। তবে তিনি বেছে নেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডানলপ ইনস্টিটিউটে জেডব্লিউএসটির কানাডীয় স্পেস এজেন্সির দলে কাজ করার সুযোগ। জেডব্লিউএসটিতে যে চারটি সরঞ্জাম আছে, তার একটি বানিয়েছে লামীয়াদের কানাডীয় দল। সেই দলেরই তোলা পাঁচটি ছবির একটি আলোচিত সেই ছবি।
গত জুলাইয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপের সময় লামীয়া বলেছিলেন, সুযোগ পেলেই দেশের জন্য একাধিক টেলিস্কোপ নিয়ে আসবেন। কথা রেখেছেন লামীয়া। এ বছর মার্চে তাঁর নিয়ে আসা টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ দেখতে শুরু করেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) সঙ্গে যৌথভাবে ‘দূরবীন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। সেখানে শিক্ষার্থীরা তাত্ত্বিক পড়াশোনার পাশাপাশি হাতে-কলমে গবেষণার সুযোগ পাবেন।
জেডব্লিউএসটি দলে গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন লামীয়া। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী ওয়েলেসলি কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার সুযোগও পেয়েছেন। লামীয়ার ইচ্ছা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মহাকাশ গবেষণার কাজে যুক্ত করার। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও যেন হয়ে ওঠে গবেষণার প্রাণকেন্দ্র, সেই স্বপ্নও দেখেন তিনি।
লেখক: প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক