‘জীবনটা আমার কোঁকড়াইয়া আছে কাপড়ের মতো’

আমাদের আশপাশেই আছে কত গল্প, ঘটনা, চরিত্র; যা হৃদয়ে নাড়া দেয়। এমনই একজনের কথা লিখেছেন মো. তসলিম উদ্দিন। পাঠক, চাইলে আপনিও লেখা ও ছবি পাঠাতে পারেন এই ইমেইলে: [email protected]

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাইড শেয়ারিং অ্যাপগুলোতে ‘লোকেশন’ ঠিক করতে গেলে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়। জায়গাটা ঠিক গোপীবাগ ৭ নম্বর লেন ও ৮ নম্বর লেনের মধ্যখানে। রিকশাচালকেরা আবার লেন-টেন বোঝেন না। তাঁদের বলতে হয়, বিন্দু গলি ও মসজিদ গলির মাঝবরাবর তিন মাথায়।

আরও পড়ুন

তিন রাস্তার মোড়ে হইহল্লা-গাড়ির শব্দ লেগেই থাকে। তিনটি রাস্তায় তিনটি দোকান। এর মধ্যে একটি লন্ড্রির। লন্ড্রির দোকানের মালিক মুন্না ভাই। ৪০ বছর বয়সী মুন্না ভাইয়ের ২৫ বছর কাটল এই তিন মাথায়। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছেন, গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। তারপর খাদ্যের অন্বেষণে চট্টগ্রাম হয়ে অবশেষে তাঁর ঠিকানা ঢাকা। জিজ্ঞাসা করলে মজা করে বলেন, ‘চাঁদপুর থেকে চিটাগং, হেরপর এই গা ঢাকা।’

আমি কাপড় ইস্ত্রি করতে গেলে পান খাওয়া দাঁতে হেসে সালাম দেন। ইস্ত্রি করতে করতে গল্পগুজব করেন। বলেন, ‘সারা জীবন খালি কাপড়ই সোজা করে গেলাম। জীবনটা আর সোজা করতে পারলাম না।’

‘ক্যান ভাই, কী হইলো?’ জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘জীবনটা আটকাইয়া রইল এই ত্রিবেণির মোড়ে। বিদেশ যাওনের চেষ্টা করছিলাম একবার। দালালে তিন লাখ টাকা মাইরা দিয়া ভাগল। এই লন্ড্রির দোকান থেইকাও তো কম টাকা কামাইলাম না। সব খাইল অসুখে। বাপের অসুখ, পোলাডারও মাথায় সমস্যা। ডাক্তারের পেছনে ঢালতেই সব শেষ।’

মুন্না ভাইয়ের বাবার ক্যানসার। ১০ বছর বয়সী ছেলের যথাযথ মানসিক বিকাশ হয়নি। মুন্না ভাই বলেন, ‘বাপে অনেক চাইছিল, আমি পড়ালেখা করি। অনেক মাইর খাইছি পড়ালেখার জইন্যে। তখন তো পড়ায় মন বসত না। সারা দিন খালি খেলতাম আর ঘুরতাম। এমনে আর কত দিন? তাই বাপে লন্ড্রির দোকানে কামে লাগাইয়া দিল। এখন বুঝি পড়ালেখার দাম। পরে বুইঝা লাভ কী? ভাবছিলাম, পোলামাইয়া হইলে তাদের পড়ালেখা করামু। আল্লাহর মাইর। দ্যাখেন কী পোলাডা হইছে আমার! জীবনটা আমার কোঁকড়াইয়া আছে কাপড়ের মতো। কোনো মিস্ত্রি নাই যে একটু ইস্ত্রি কইরা দিবে।’

মুন্না ভাইয়ের কথা শুনতে শুনতে গভীর ভাবনায় হারিয়ে যাই। জীবন ঠিক করার মতো মিস্ত্রি কি জগতে আছে?