যদি সব ছেড়ে দিতাম, তাহলে আজ কোথায় থাকতাম

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইমোরি ইউনিভার্সিটিতে সমাবর্তন বক্তৃতা দিয়েছেন মার্কিন অভিনেতা ও পরিচালক টাইলার পেরি। বারবার ধাক্কা খেয়ে কীভাবে তিনি স্বপ্নপূরণের স্বাদ পেয়েছেন, সে কথাই উঠে এসেছে তাঁর কথায়।

টাইলার পেরি
ছবি: সংগৃহীত

অভিনন্দন ২০২২ সালের স্নাতকেরা। তোমাদের নিয়ে আমি ভীষণ আনন্দিত, গর্বিত। তোমরা পেরেছ। যে ব্যাপারটা আমাকে সব সময় রোমাঞ্চিত করে, তা হলো তোমাদের জন্মানোর এই অভূতপূর্ব সময়। তোমরা জন্মেছ ইন্টারনেটের যুগে। জন্মের পর থেকেই এমন একটা পৃথিবী দেখছ, যেখানে সবকিছু দ্রুত হয়ে যায়, যা কিছু চাও, সবই তোমার ফোনে পাওয়া যায়।

খাবার চাও? কয়েকটা বাটন চাপো, খাবার হাজির। রাস্তা খুঁজছ? ফোনে পেয়ে যাবে। তথ্য চাও। ফোন চাপো। তা-ও মিলবে। যদি কারও সঙ্গে ডেটে যেতে চাও... (হাসি), আমি জানি ইমোরির শিক্ষার্থীরা এমন নয়, তবে যা বলতে চাচ্ছি, এটাও তুমি ফোনেই পাবে।

এ কারণেই আমি খুব রোমাঞ্চ নিয়ে তোমাদের দেখি। তোমাদের কখনো কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। সব মিলে যায় আঙুলের ছোঁয়ায়! এখনই চাই, এখনই চাই! কিন্তু সত্যি বলতে এ কারণে তোমাদের নিয়ে আমার দুশ্চিন্তাও হয়। দুঃখ হয়।

এটুকু শুনেই ‘হ্যাশট্যাগ টাইলার পেরিকে বর্জন করো’ লেখা শুরু কোরো না প্লিজ। আমাকে কথা শেষ করার সুযোগ দাও।

আরও পড়ুন

আমার দুঃখ হয়; কারণ, তোমরা জানো না মানচিত্র কাকে বলে। মানচিত্র এমন একটা জিনিস, যেটা গাড়ির ভেতর বসে খোলা যায় না; কারণ, এটা অনেক বড়। গাড়ির বনেটেরে ওপর পুরোটা বিছিয়ে মনোযোগ দিয়ে পথ খুঁজতে হয়—কীভাবে আমি দাদির বাড়ি পৌঁছতে পারি? রেকর্ডের দোকান কী জিনিস, তা-ও তোমরা জানো না। এখানে অ্যালবাম কিনতে পাওয়া যায়, ক্যাসেট টেপ পাওয়া যায়। গাড়িতে বসে একটা গান শুনতে গিয়ে হয়তো আবিষ্কার করলে, ক্যাসেটের টেপটা পেঁচিয়ে গেছে। তখন আবার পুরো টেপ বের করে ক্যাসেটের ভেতরে ভরার চেষ্টা শুরু করলে...। আমি জানি আমার কথা পাগলের মতো শোনাচ্ছে। হয়তো মনে মনে বলছ, ‘টাইলার, তুমি কত বুড়ো!’

তোমাদের তুলনায় আমাদের সময়টা হয়তো অনেক কষ্টকর ছিল। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাগুলোর সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—কিছু পেতে হলে শ্রম দিতে হয়, সময় দিতে হয়। তোমরা যে সময়টাতে বড় হচ্ছ, সে সময় তোমাদের অনেককে বাস্তবতা সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা দিচ্ছে। সাফল্য অত দ্রুত আসে না। কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ ছাড়া বেশির ভাগ স্বপ্নই পূরণ হয় না। এ কথা আমি জেনেছি আমার অধ্যাপকদের কাছ থেকে।

অপেক্ষা আর ধৈর্যের শিক্ষা

আমি কখনো কলেজে যাইনি। তবু অনেক অধ্যাপকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তাঁরা শিক্ষাবিদ নন, কিন্তু আমার চোখে অধ্যাপক ঠিকই। যেমন আমার খালা। তাঁর নাম মে। লুজিয়ানার প্রত্যন্ত গ্রামে তাঁর সঙ্গে আমার গ্রীষ্মগুলো কাটত। ভোরবেলা তিনি আমাকে ঘুম থেকে তুলে মাঠে নিয়ে যেতেন। মাটিতে ছোট ছোট গর্ত করতেন। আমার দায়িত্ব ছিল সেই গর্তে বীজ ফেলা। প্রতিদিন এই একই রুটিন। যেহেতু পুরো গ্রীষ্মটাই ওখানে কাটত, প্রতিদিন আমি ভাবতাম, পরদিন হয়তো দেখব বীজ থেকে একটা কিছু গজিয়েছে। কিন্তু না। আমি হতাশ হতাম। খালা বলতেন, ‘খোকা, আমাদের কাজ শুধু বপন করা। গাছটা বাড়বে কি না, এটা সৃষ্টিকর্তার ওপর নির্ভর করছে।’ এ কথা আমি কখনো ভুলিনি।

১৯ বছর বয়সে আমি আমার প্রথম নাটকটা লিখি। আটলান্টাতে কিছুদিন চাকরি করার পর হাতে বেশ কিছু টাকা জমল। আমার প্রথম নাটকটা মঞ্চস্থ করার জন্য একটা থিয়েটার ভাড়া করলাম। ভেবেছিলাম সপ্তাহজুড়ে ১ হাজার ২০০ দর্শককে নাটকটা দেখাতে পারব। এসেছিল মাত্র ৩০ জন। কিন্তু এই ৩০ জনের মধ্যেই একজন বিনিয়োগকারী পেয়ে গেলাম। তারপর? কিছুই না। আবারও সেই দর্শকখরা। আবারও বিনিয়োগ পেলাম। কিন্তু দর্শক পেলাম না। দেশের নানা প্রান্ত ঘুরে নাটকটা মঞ্চস্থ করলাম। সাত বছর ধরে এভাবেই চলল। ফলাফল শূন্য।

একসময় অবস্থা এতই খারাপ হয়ে পড়ল যে বাড়িওয়ালার চোখ ফাঁকি দিতে আমি গাড়িতে ঘুমানো শুরু করলাম। ভেবেছিলাম সব ছেড়ে দিই। আত্মহত্যার চিন্তাও মাথাও এসেছিল। কিন্তু তারপরও যা আমাকে পরের দিনটার জন্য আশাবাদী করছিল, তা হলো সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা।

যে কথা কেউ বলেননি

মা বলেছিল একটা চাকরি করো। এসব ছাড়ো। সেই সময়েই আমার একজন প্রোমোটারের সঙ্গে পরিচয় হয়, তাঁর নাম প্রাইমাস। তিনি আমার জীবনের অন্যতম অধ্যাপক। প্রাইমাস আরও একবার আমার নাটকে বিনিয়োগ করতে রাজি হলেন। আমি খোঁজ পেয়েছিলাম, নাটকের বিজ্ঞাপন দেওয়ার মতো টাকা তাঁর কাছে ছিল না। অথচ পুরো শহরজুড়ে আমার নাটকের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ছিল। আমি বললাম, ‘এটা কীভাবে সম্ভব হলো!’ তিনি বললেন, ‘মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালো। ওরা জানে, টাকা হাতে পেলে আমি ওদের ঋণ শোধ করে দেব।’ সেই শো-এর সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেল। আরও দুটা শো করলাম। সেগুলোও হাউসফুল। যখন হাল ছেড়ে দেব বলে ভাবছিলাম, তখনই আমার স্বপ্ন ধরা দিতে শুরু করল।

প্রায়ই ভাবি, ওই সময় যদি সব ছেড়ে দিতাম, তাহলে আজকে আমি কোথায় থাকতাম। এ জীবনে যত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে, সবাই বলেছেন আমি কী হতে পারব না। কিন্তু আমি কী হতে পারি, সেটা কেউ বলেননি।

এরপর আমি শত শত শো করেছি। টিভিতে কাজ করেছি, সিনেমায় কাজ করেছি। ২৪টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি, যার মধ্যে বেশ কয়েকটা বক্স অফিসে ১ নম্বরে ছিল। আমার একটা স্টুডিও আছে, যেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষ কাজ করতে আসেন। আমি জানি, একটা স্বপ্নপূরণ হতে কত দীর্ঘ সময় লাগে।

যেমনটা আমার মে খালা শিখিয়েছিলেন। তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। তোমার কাজ হলো বীজটা বপন করা। এরপর সূর্যের আলো, মেঘ, বৃষ্টি, কিছুই তোমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। তোমাকে শুধু সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রাখতে হবে।

তোমার পদচিহ্ন

একবার আমি আমার চার বছরের সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে সাগরতীরে হাঁটছিলাম। মাথার ওপর কড়া রোদ। ভাবছিলাম, কোনোমতে সৈকত পেরিয়ে একটু বসার জায়গা পেলে বাঁচি। ছেলে আমার পেছন পেছন হাঁটছিল। হাঁটছিল না, বলা উচিত লাফাচ্ছিল। লাফ দিচ্ছিল, পড়ে যাচ্ছিল, আবার লাফ দিচ্ছিল।

একসময় আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। পেছনে ফিরে তাকালাম। দেখি আমার ছেলের সারা গা সৈকতের বালিতে মাখামাখি। ওর মুখে বালি, হাতে বালি। আমি বললাম, ‘কী করছ তুমি?’ সে এমন একটা কথা বলল, যা আমাকে ভীষণ নাড়া দিল। সে বলল, ‘দেখো বাবা, আমি তোমার পায়ের ছাপ অনুসরণ করছি।’ আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি ওর হাত ধরলাম। বাকিটা পথ আমরা হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি হাঁটলাম। সৈকতের শেষ প্রান্তে পৌঁছলাম। ওকে বললাম, ‘এখন দেখো। তোমার পায়ের ছাপ তুমি নিজেই তৈরি করেছ। বাবা তৈরি করেছে বাবারটা।’

আজ তোমাদের বলতে চাই, জীবনটা তোমার। তোমার মা-বাবার নয়। অন্য কারও নয়। তোমার নিজের পথ বেছে নিতে, অচেনা রাস্তায় নিজের পায়ের ছাপ ফেলে যেতে কখনো ভয় পেয়ো না।

ইংরেজি থেকে অনূদিত

সূত্র: ইমোরি ইউনিভার্সিটির ইউটিউব চ্যানেল