২৬ বছর বয়সে আমার ‘জন্ম’ হয়েছে

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ)–এর ১০ শিক্ষার্থীকে প্রতিবছর ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি দেয় প্রথম আলো ও আইডিএলসি। শুধু এটিই নয়, সুবিধাবঞ্চিত আরও বহু নারীকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে চট্টগ্রামের এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেমন ‘তৈরি পোশাকশিল্প’ খাত থেকে এ পর্যন্ত ১২৩ জন আন্তর্জাতিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন মারুফা খাতুন। হাজারো বাধা পেরিয়ে সাফল্যের দেখা পাওয়া এই নারীর কথা নিশ্চয়ই আরও অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হবে। অনুলিখন করেছেন জিনাত শারমিন

অনেক বাধা পেরিয়ে মারুফা আজকের অবস্থানে পৌঁছেছেন
ছবি: মারুফা খাতুনের সৌজন্যে

কোনো দিন আমাকে কেউ লেখাপড়ার কথা বলেনি। তবু কীভাবে যেন একদম ছোটবেলায়ই বুঝে গিয়েছিলাম, লেখাপড়াতেই আমার একমাত্র মুক্তি। নিজ উদ্যোগে বিনা মূল্যে পড়ানো হয়, এ রকম একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর থেকেই পরিবার ও আশপাশের লোকজন বিয়ে নিয়ে উঠেপড়ে লাগে। নিজেই একের পর এক নিজের বিয়ে ভেঙেছি। দুবার এমনও হয়েছে, বিয়ের দিন আমার স্কুলের শিক্ষক বা গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ডেকে এনে বিয়ে ভাঙতে হয়েছে। 

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার চাঁন্দপাড়া গ্রামে হতদরিদ্র পরিবারে আমার জন্ম। চার ভাই-বোনের ভেতর আমি সবার বড়। দুই ভাই, দুই বোন। বাবা দিনমজুর, যখন যা কাজ পেতেন, করতেন। মা গৃহিণী। 

এসএসসি পরীক্ষার তিন মাস আগে বাবা মারা গেলেন। পুরোপুরি ভেঙে পড়লাম। চান্দপাড়া বিএল হাই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। ভালো ছাত্রী ছিলাম বলে শিক্ষকেরা ব্যাচে ফ্রি পড়াতেন। সরকারি বইগুলো ছাড়া অন্য বই কেনার সামর্থ্য ছিল না। বান্ধবীর বাসায় গিয়ে ওর বই ও গাইড পড়তাম। দেখতে মোটামুটি ভালো বলে আশপাশের মানুষ টিকতে দিচ্ছিলেন না। পরীক্ষার তিন মাস পর আমার বিয়ে হয়ে গেল। যুদ্ধ করতে করতে আমিও তখন ক্লান্ত। তবে বিয়ের আগে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—লেখাপড়া বন্ধ করব না। 

আমার স্বামী ক্লাস ফাইভ পর্যন্তও পড়তে পারেনি। শ্বশুরবাড়িও হতদরিদ্র। ‘স্বাভাবিকভাবেই’ সে বাড়ির কেউ আমাকে পছন্দ করেনি। আমার দরিদ্র মা যৌতুক দিতে পারেননি। তাই যত যা-ই করি না কেন, কিছুতেই শ্বশুরবাড়ির কারও মন জিততে পারিনি। 

এসএসসির ফল বেরোলে শ্বশুরবাড়ি থেকে সাফ জানিয়ে দিল, আর লেখাপড়া করা যাবে না। স্বামীকে জানিয়ে দিলাম আমি তাঁকে ছেড়ে দেব; কিন্তু পড়াশোনা ছাড়ব না। গোবিন্দগঞ্জ মহিলা কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। প্রথম বর্ষেই গর্ভে সন্তান এল। যেহেতু তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কলেজে ভর্তি হয়েছি, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার-নির্যাতনও বেড়ে গেল। তিন মাসের বাচ্চা নিয়ে ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিই। ভোরে উঠে ঘরের সব কাজ ও রান্নাবান্না করতাম। ছোট্ট বাবুর কাপড় পরিষ্কার করতাম। সারা দিন বাচ্চা ও সংসার সামলে রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে পড়তে বসতাম। 

পরীক্ষায় আমার সিট পড়েছিল জানালার পাশে। ছোট ভাইকে নিয়ে যেতাম। পরীক্ষা চলাকালীন জানালা দিয়ে দেখতাম, ছোট ভাইটা আমার বাবুকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, আমার বাচ্চাটা চিৎকার করে কাঁদছে। সে সময় আমার স্বামী, শাশুড়ি, পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী—কেউ একটু সাহায্য করেননি! 

এইচএসসি পরীক্ষার পর চার মাসের বাচ্চা, মা আর ছোট বোনকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। কেননা, আমিই ছিলাম পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দুই ভাইয়ের একজন তখন পঞ্চম শ্রেণিতে, অন্যজন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। ওরা নিজেরাই স্কুলে যেত, ফিরে এসে রান্না করে খেত, ঘুমাত। ওদেরও দেখার কেউ ছিল না। মাকে একটা গার্মেন্টসে চাকরি নিয়ে দিই। নিজেও একটা গার্মেন্টসে চাকরি নিই। আমার সন্তানকে তখন বোনের কাছে রেখে কাজে আসতাম। বাচ্চা বেশি কাঁদলে বোন ওকে গার্মেন্টসের গেটে নিয়ে আসত। দারোয়ান চাচা আমাকে সেখানে ছোট্ট একটা ঘরে বাবুকে দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

এখন ভাড়া বাসায় মেয়েকে নিয়ে থাকেন মারুফা
ছবি: মারুফা খাতুনের সৌজন্যে

 সেই গার্মেন্টসে বেশি দিন টিকতে পারিনি। বৈষম্যের শিকার হই। মানতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দিই। কয়েক মাস ঘরেই ছিলাম। এর ভেতর এইচএসসি পরীক্ষার ফল বেরোল। কোন গার্মেন্টসে কাজের পরিবেশ ভালো, খোঁজ নিয়ে মোহাম্মদী গ্রুপে যোগ দিই। পাশাপাশি ভর্তি হই একটা ডিগ্রি কলেজে; কিন্তু ১০ ঘণ্টা চাকরি, ওভারটাইম, বাচ্চা—সব মিলিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছিলাম না। 

একদিন গার্মেন্টসের মানবসম্পদ বিভাগের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, আমাদের জন্য এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন ও গার্মেন্টসের পক্ষ থেকে একটা বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। পাঁচ বছর থাকা, খাওয়া ও মাস্টার্স পর্যন্ত পড়াশোনা, সব ফ্রি। প্রায় ৭৫ লাখ টাকার বৃত্তি। এই সময়টাতে আমি গার্মেন্টসের বেতনও পাব। 

সামনেই তখন পরীক্ষা। আমার মনে হলো, এই সুযোগের জন্যই আমি এত দিন বেঁচে আছি। আবার পড়াশোনা শুরু করলাম। যেদিন ঘোষণা এল আমি বৃত্তিটা পেয়েছি, ওই মুহূর্তের কথা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। শুনে আমার পরিবার ও শ্বশুরবাড়ির সবাই খুব খুশি হলো। 

আরও পড়ুন

শ্বশুরবাড়ির মানুষ আমার স্যালারি অ্যাকাউন্টটা রেখে দিল। ফলে প্রতি মাসের সব টাকা ওরাই খরচ করত; কিন্তু আমার বাচ্চার কোনো দায়িত্ব নিতে রাজি ছিল না। ২০১৮ সালে ঢাকায় মা ও বোনের কাছে দেড় বছরের বাচ্চাকে রেখে (ডর্মে বাবু রাখার নিয়ম নেই) চলে এলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, চট্টগ্রামে। 

সারা জীবন বাংলা মাধ্যমে পড়েছি। ইংরেজি মাধ্যম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে একটু বিপাকেই পড়লাম। ক্লাসে তো বটে, আমার রুমমেটের সঙ্গে কথা বলতেও সমস্যা হতো। কারণ, সে ভারতীয়। আমি তো হিন্দি, ইংরেজি কোনোটাই ভালো বলতে পারি না। 

ইংরেজি শেখা শুরু করলাম। তিন মাসে অনেকটা এগিয়েও গেলাম। শুরু হলো পড়াশোনা। টিউশনি করে কোনো রকমে নিজের খরচ চালাতাম আর ঢাকায় বাচ্চার খরচ পাঠাতাম। প্রায় দুই বছর কাটল। শুরু হলো মহামারিকাল। ঢাকা থেকে বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেলাম গাজীপুর, স্বামী তখন সেখানেই থাকতেন। সে সময়ে আবারও সন্তানসম্ভবা হলাম। করোনার প্রকোপ একটু কমলে চট্টগ্রামে গেলাম বটে; কিন্তু শারীরিক অবস্থা তখন এত খারাপ ছিল যে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারলাম না। আবারও ফিরে গেলাম গাজীপুরে। আমার আট মাসের সন্তান পেটেই মারা গেল। 

এ পুরো সময় শরীরের ওপর দিয়ে রীতিমতো ঝড় বয়ে গেছে। মনের খবর বাদই দিলাম। সবকিছু থেকে ছয় মাসের বিরতি নিয়ে আবার নতুন করে জীবনযুদ্ধ শুরু করতে বললেন চিকিৎসক। তত দিনে আমি দুই সেমিস্টার পিছিয়ে গেছি। তাই সেই সেমিস্টারেই একগাদা কোর্স নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। আমার জন্য পড়াশোনাটাই ছিল সেরে ওঠার প্রক্রিয়া। যত নতুন কিছু শিখেছি, ততই শারীরিক আর মানসিকভাবে সেরে উঠেছি। ছয় মাস পর যখন সব কোর্সে ভালোভাবে পাস করলাম, কী যে আত্মবিশ্বাস পেলাম…! মনে হলো আমার সামনে যত বাধা, যত দুর্যোগই আসুক না কেন, ঠিক কাটিয়ে উঠব। 

২০২১ সাল থেকে নিজের হেরিটেজ ফ্যাশন স্টার্টআপ এম আর কালেকটিভ নিয়ে কাজ শুরু করি। ইউনিসেক্স টি-শার্টের ওপর হাতের এমব্রয়ডারিতে দেশীয় সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ তুলে ধরাটাই ছিল আইডিয়া। সেগুলোর ক্রেতাও মূলত বিদেশি। এ ক্ষেত্রে আমাকে (মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের উপাচার্য) রুবানা (হক) ম্যাডাম অনেক সাহায্য করেছেন। তাঁর গার্মেন্টস ব্যবহার করতে দিয়েছেন, কাপড় দিয়েছেন, আইডিয়াটা বড় করতে সাহায্য করেছেন, যা যা দরকার সব কিছুতেই তিনি পাশে ছিলেন। ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে আমার এ উদ্যোগটা এখন বন্ধ আছে। পড়াশোনা শেষে আবার পুরোদমে শুরু করব। 

বিয়ের প্রায় ১০ বছর পর স্বামীর সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ হয় কিছুদিন আগে। তাঁর বা আমার শ্বশুরবাড়ির প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। আমি কেবল স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই। নিজেকে আর আমার মেয়ে রোদসীকে একটি সুন্দর জীবন দিতে চাই। 

আমার বয়স এখন ২৬। অথচ মনে হয়, জীবন বুঝি এখান থেকেই শুরু হলো। 

একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি। আমি আর আমার মেয়ে থাকি। এক ভাইকে দেশের বাইরে পাঠিয়েছি। মা আর বোনদের মাসে মাসে টাকা পাঠাই। অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক করেছি। এখন একসঙ্গে দুইটা মাস্টার্স করছি। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে অ্যাপারেল অ্যান্ড ফ্যাশন বিজনেস ম্যানেজমেন্টে, আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ। পাশাপাশি ইউএস সার্টিফায়েড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট (সিএমএ)-এর পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছি। ফিন্যান্স নিয়ে তৃতীয় মাস্টার্সটা দেশের বাইরে করতে চাই। আবেদন করা শুরু করেছি। ভবিষ্যতে আমি চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার বা ফিন্যান্স অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করতে চাই। আর নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে করতে চাই অনেক বড়। 

আরও পড়ুন