চা–শ্রমিকদের মজুরি বাড়ার ৫ মাস
এই বাজারে ৫০ টাকা মজুরি বাড়িয়ে সাবিত্রী বাউরিদের কতটা লাভ হলো
মজুরি বাড়ানোর দাবিতে গত আগস্টে আন্দোলন নেমেছিলেন চা–শ্রমিকেরা। সে আন্দোলনে সাবিত্রী বাউরিও যোগ দিয়েছিলেন। দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবি ছিল। তিন সপ্তাহের আন্দোলনের পর বহু আলোচনা ও সমঝোতা শেষে দৈনিক মজুরি ৫০ টাকা বাড়ানো হয়। সাবিত্রীর দিনের মজুরি ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১৭০ টাকা হয়েছে। ২১ বছর বয়সী সাবিত্রীর ভাষায়, এই বাজারে ৫০ টাকা মজুরি বাড়লে কোনো লাভ হয়!
সাবিত্রী বাউরির সঙ্গে ৩ জানুয়ারি কথা হয় সিলেটে তাঁর মাটির ঘরের সামনে। জায়গাটিকে শ্রমিকেরা ‘বস্তি লাইন’ বলে থাকেন।
২০২২ সালের ৯ আগস্ট থেকে দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি ও ১৩ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট করেন চা–শ্রমিকেরা। ওই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে বিভিন্ন সংগঠন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চা–শ্রমিকদের পক্ষে দাঁড়ান লোকজন। ফেসবুকে চা–শ্রমিক মাকে নিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সন্তোষ রবিদাস। ৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে তাঁর বৃদ্ধ মায়ের ১২০ টাকা রোজগার আর অভাব-অনটনে বড় হওয়ার কথা মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
তিন সপ্তাহের আন্দোলনের পর ২৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চা-বাগানের মালিকদের বৈঠকে শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করা হয় ১৭০ টাকা।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) তথ্য অনুসারে, দেশে নিবন্ধিত চা–বাগানের সংখ্যা ১৬৬। এর মধ্যে সিলেট বিভাগেই আছে ১৩৫টি। দেশে চা–কর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে অস্থায়ী কর্মী ৩৬ হাজার। মোট চা–কর্মীর ৫০ শতাংশই নারী।
‘এত কম টাকায় সংসার চলে না’
সাবিত্রী বলেন, তাঁর দাদা-দাদি, বাবা-মা সবাই চা–বাগানের শ্রমিক ছিলেন। তাঁর স্বামী মনজন বাউরি খাদিম চা–বাগানের স্থায়ী কর্মী। সাবিত্রী একই বাগানের অস্থায়ী কর্মী। এক বছর ধরে কাজ করছেন। টিনের চালের মাটির ঘরটি স্বামীর কাজের সূত্রে পেয়েছেন। চা–বাগানের স্থায়ী কর্মীরা রেশন, থাকার জন্য ঘর, বাগানের স্কুলে বিনা মূল্যে শিশুদের পড়ানো ও সাধারণ স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন সুবিধা পান।
সাবিত্রী বলেন, মজুরি ৫০ টাকা বাড়ার খবর পেয়ে বেশ হতাশ হন তিনি। তিন কেজি রেশনের চাল পান। এর বাইরে বাজার থেকে চাল কিনতে হয়। সপ্তাহে এক দিন মাছ বা মুরগির মাংস খান। বাকি দিনগুলো শাকসবজি দিয়ে চলে। সন্তান একটি। সংসারে শাশুড়ি, ননদ আছে।
সাবিত্রীর প্রতিবেশী তমা গোয়ালার স্বামী আপন গোয়ালা চা–বাগানের স্থায়ী শ্রমিক। স্বামীর অল্প আয়ে সংসার চালানোর ভার সামলাতে হয় তমাকেই। প্রথম আলোকে তমা বলেন, ‘মজুরি ৫০ টাকা বেড়েছে। অথচ বাজারের জিনিসপত্রের কত দাম দেখেন! এত কম টাকায় সংসার চলে না।’ তমার সংসারে দুই সন্তান, শাশুড়ি, ননদসহ মোট সদস্য সাতজন। তিনি জানান, একজন শ্রমিক পুরো সপ্তাহ কাজ করলে (ছুটির এক দিন বাদে) রেশনের তিন কেজি চাল পান। অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে কোনো শ্রমিক সপ্তাহে এক দিন অনুপস্থিত থাকলে তিনি আর রেশন পান না। তাঁর সংসারে সপ্তাহে সাত কেজি চাল বাইরের দোকান থেকে কিনতে হয়। বাজারে মোটা চালের কেজি এখন ৪৮ থেকে ৫০ টাকা।
শ্রীমঙ্গলের সিন্দুরখান চা–বাগানের কর্মী শুভা গোয়ালাও আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, একজন শ্রমিক দিনে ২৪ কেজি চা–পাতা তুলে জমা দিতে পারলে ১৭০ টাকা পাবেন। মৌসুমে ২৪ কেজির বেশি চা–পাতা তোলা যায়, তখন বাড়তি পাতার জন্য বাড়তি অর্থ পাওয়া যায়। শীতকালের মতো বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময় চা–পাতা তোলার মৌসুম নয়। ওই সময় চারা কলম করা, আগাছা পরিষ্কার ও পানি দেওয়ার কাজ করতে হয়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, চা–শ্রমিকদের যাঁদের তিন থেকে চারটি সন্তান রয়েছে, তাঁদের দুর্ভোগের কোনো সীমা নেই। তাঁরা ঠিকমতো খেতেও পান না।
চা–শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বাড়ানোর ঘোষণার সঙ্গে জানানো হয়েছিল, ভবিষ্য তহবিলে নিয়োগকর্তার চাঁদা, বার্ষিক ছুটি, বেতনসহ উৎসব ছুটি আনুপাতিক হারে বাড়বে। অসুস্থতাজনিত ছুটি, ভর্তুকি মূল্যে রেশন–সুবিধা, চিকিৎসাসুবিধা, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের পেনশন, চা-শ্রমিকদের পোষ্যদের শিক্ষা বাবদ ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ, গোচারণভূমি বাবদ ব্যয়, বিনা মূল্যে বসতবাড়ি ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ শ্রমিককল্যাণ কর্মসূচি এবং বাসাবাড়িতে উৎপাদন বাড়বে। সবকিছু মিলিয়ে দৈনিক মজুরি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকার মতো পড়বে।
তবে সাবিত্রী ও শুভা বলেন, মজুরি বাড়ানো ছাড়া বাকি কোনো সুবিধা শ্রমিকেরা এখনো পাননি। ২৯ হাজার টাকা এরিয়ার পাওয়ার কথা, সেটাও পাননি।
এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি ঘোষণায় যেহেতু মজুরি বেড়েছে, এ বিষয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের কোনো চুক্তি যেহেতু হয়নি, তাই বাড়তি বেতনের এরিয়ার পাওয়ার সুযোগ শ্রমিকদের নেই।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার নারী ভাইস চেয়ারম্যান মিতালি দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, চা–শ্রমিকদের দাবিদাওয়া পূরণে ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে।
গত মার্চ মাসে ইউনিসেফের সহায়তায় র্যাপিড ‘সিলেট বিভাগের চা–বাগানের নারী ও শিশুদের সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা জোরদারে করণীয়’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬১ শতাংশ চা–কর্মী ও তাঁদের পরিবার দরিদ্র, যা জাতীয় দারিদ্র্য হারের ৩ গুণ বেশি। চা–বাগানে চরম দারিদ্র্যের হার প্রায় ৪৩ শতাংশ। আবার পুরুষপ্রধান পরিবারে চরম দারিদ্র্যের হার ৪২ হলেও নারীপ্রধান পরিবারে আরও বেশি—৪৭ শতাংশ। তবে মজুরি বাড়ায় সেই দারিদ্র্য কমেছে কি না, সে সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
‘মালিকদের সামর্থ্যও বুঝতে হবে’
চা-বাগানের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের সভাপতি মো. শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, এমন কোনো শিল্প নেই, যেখানে এভাবে একবারে ৪১ শতাংশ মজুরি বেড়েছে। কিছু বাগান ১৬ থেকে ২০ কেজি পাতা তুললেও ১৭০ টাকা মজুরি দিচ্ছে। পাশাপাশি বাসস্থান, বিনা মূল্যে পড়াশোনা, চিকিৎসা, রেশন ইত্যাদি সামাজিক সুবিধা দেওয়া হয়। তবে এসব সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে খুব কমই কথা বলতে শোনা যায়। তিনি বলেন, চা উৎপাদন আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। ১০ বছরেও চায়ের দাম বাড়েনি। ব্যয় সামলাতে না পেরে অনেক চা–বাগান বন্ধও হয়ে গেছে। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ চা–বাগান লোকসানে আছে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। তাই শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো বিষয়ে যৌক্তিক হতে হবে। মালিকদের সামর্থ্যও শ্রমিকদের বুঝতে হবে। দিন ভালো থাকলে মালিকেরা কখনো শ্রমিকদের বঞ্চিত করেন না।