মেসেঞ্জারে নীল ছবিযুক্ত ভিডিও পাঠিয়েছিলেন অফিসের বস

পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার

মিতি সানজানা

প্রশ্ন: আমার স্ত্রী একটি নামকরা এনজিওতে চাকরি করেন। ওই এনজিওর নির্বাহী পরিচালক ফেসবুক মেসেঞ্জারে তাঁকে নীল ছবিযুক্ত ভিডিও দেন। এ নিয়ে মামলা করা হয় ডিজিটাল আইনে। মামলা করার কিছুদিনের মধ্যে তিনি ক্ষমা চেয়ে নেন। একই সঙ্গে এ ধরনের ভুল আর হবে না বলে একটি অঙ্গীকারনামা দেন। এ ঘটনার এক বছর পর সেই লোক আর তাঁর স্ত্রী মিলে অনেক ধরনের অপবাদ দিয়ে চিঠি দেন। তারপরও তাঁরা আমার স্ত্রীকে চাকরি থেকে বাদ দিতে পারেননি। এর মধ্যেই আমার স্ত্রী দীর্ঘ ১১ বছর পর অন্তঃসত্ত্বা হন। কিন্তু তারপরও অসুস্থতায় তাঁকে ছুটি না দিয়ে অফিস করতে বাধ্য করেন। একদিন অফিসে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার পর তাঁরা আমার স্ত্রীকে হাসপাতালে না নিয়ে বাসায় ফেলে রেখে যান। পরে তাঁকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলেন, মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। এ ঘটনার পর আমার স্ত্রী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এরপরও তাঁকে অযৌক্তিকভাবে কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়ে মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত করা হয়। এরই মধ্যে কয়েক দিন আগে তাঁদের অফিসের মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের প্রধানকে সেই নির্বাহী পরিচালক ঠিক একই রকম কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব পাঠান। সেই কর্মকর্তা জানালেন, তাঁকে ডেকে বলা হয়েছে—‘হয় টাকা নিয়ে মিটমাট করেন, নতুবা আপনার ইনক্রিমেন্ট বন্ধ, বেতনও আর বাড়বে না।’ এ অবস্থায় আমরা কীভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি? লোকটার যথাযথ শিক্ষা হওয়া জরুরি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

উত্তর: আপনার স্ত্রী ওই নির্বাহী পরিচালকের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছেন, সেটি কী অবস্থায় আছে জানাননি। কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সব ধরনের হয়রানি বন্ধের উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট একটি রায় দেন। রায়ে হাইকোর্ট দেশের সব সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক কোম্পানি, গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ নামে কমিটি গঠন করার আদেশ দেন। হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক সব প্রতিষ্ঠানে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন বাধ্যতামূলক।

হাইকোর্টের ওই নির্দেশনায় বলা আছে, কমিটিতে কমপক্ষে পাঁচজন সদস্য থাকবেন। বেশির ভাগ সদস্যকে হতে হবে নারী। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে দুজন সদস্য নিতে হবে এবং সম্ভব হলে একজন নারীকে কমিটির প্রধান করতে হবে। এ বিষয়ে সচেতনতা ও জনমত তৈরির জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, সব প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করতে হবে এবং সংবিধানে বর্ণিত লিঙ্গীয় সমতা ও যৌন নিপীড়ন–সম্পর্কিত দিকনির্দেশনাটি বই আকারে প্রকাশ করতে হবে। হাইকোর্টের এ নির্দেশনা আইনে রূপান্তর না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ নির্দেশনাই আইন হিসেবে কাজ করবে এবং সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এ আইন প্রযোজ্য হবে।

হাইকোর্টের রায়ে যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, শারীরিক, মানসিক, মৌখিক যেকোনো ধরনের নির্যাতনই যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। ই-মেইল, এসএমএস, টেলিফোনে বিড়ম্বনা, পর্নোগ্রাফি, যেকোনো ধরনের অশালীন চিত্র, অশালীন উক্তিসহ কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে ‘সুন্দরী’ বলাও যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। কোনো ধরনের অশালীন উক্তি, কটূক্তি করা, কারও দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো ইত্যাদি আইনের দৃষ্টিতে যৌন হয়রানি হিসেবে গণ্য করা হয়। রায়ে বলা আছে, কোনো নারীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, যেকোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন, অশালীন চিত্র, দেয়াললিখন, আপত্তিকর কিছু করা যৌন হয়রানির মধ্যে পড়বে। আপনার স্ত্রীর বস তাঁর সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করছেন, নিঃসন্দেহে তা হয়রানির মধ্যে পড়ে।

যেহেতু আপনার স্ত্রী একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, সে ক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই সেই প্রতিষ্ঠানে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’তে তাঁর অভিযোগ জানাতে পারবেন। যে কেউ যৌন হয়রানি করলে ওই কমিটির কাছে ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা অভিযোগ জানাতে পারবেন। পরিস্থিতি বিবেচনা করে, সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে যদি অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ প্রমাণিত হয়, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে অসদাচরণের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। এ ধরনের কোনো কমিটি না থাকলে তিনি অবশ্যই মানবসম্পদ বিভাগে তাঁর অভিযোগ জানাবেন। তবে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। আপনারা ইতিমধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ব্যবস্থা নিয়েছেন।

আপনার স্ত্রী যদি শ্রমিক হিসেবে শ্রম আইনের আওতায় পড়েন, সে ক্ষেত্রে তাঁর বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে প্রসূতিকালীন সময়ে পূর্ণ বেতনে মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করার অধিকার আছে। কয়েকটি শর্তের ভিত্তিতে মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রদান করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ৪৫ ধারায় বলা আছে, অন্তঃসত্ত্বা শ্রমিক, সন্তান প্রসবের আগে ৮ সপ্তাহ এবং প্রসবের পরের ৮ সপ্তাহ, মোট ১৬ সপ্তাহ পূর্ণ মজুরিতে মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়ার অধিকার রাখেন।

কোনো নিয়োগকর্তা যদি জেনে থাকেন যে তাঁর অধীন কোনো নারী শ্রমিক অন্তঃসত্ত্বা এবং আগামী ১০ সপ্তাহের মধ্যে তিনি সন্তান প্রসব করতে পারেন, তাহলে ওই শ্রমিককে তিনি এমন কোনো ভারী, ঝুঁকিপূর্ণ বা কষ্টকর কাজে নিয়োগ করবেন না, যার কারণে অনাগত শিশুটি মায়ের গর্ভে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত কাজের এই আইন মেনে চলতে হবে। আপনার স্ত্রী যদি ছুটির নোটিশ দিয়ে থাকেন বা তিনি তাঁর বসকে শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত করে থাকেন, তবে অবশ্যই আইন অনুযায়ী আপনার স্ত্রী ছুটি পাওয়ার অধিকারী। সে ক্ষেত্রে যেহেতু তিনি আপনার স্ত্রীকে ছুটি দেননি বরং মানসিক নির্যাতন করেছেন, এ জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে (বোর্ড) অভিযোগ জানাতে পারেন। সেই সঙ্গে শ্রম অধিদপ্তরে অভিযোগ জানাতে পারেন। সেই সঙ্গে হয়রানি ও হুমকির জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে পারেন। এ ধারায় প্রতিকার সাধারণত শান্তি রক্ষার মুচলেকার মামলা বলেই পরিচিত। ১০৭ ধারায় মামলা রুজু করে প্রতিপক্ষ কিংবা দায়ী ব্যক্তিকে শান্তি বজায় রাখার জন্য বন্ড বা মুচলেকা সম্পাদনের জন্য বাধ্য করা যায়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে আরজি উপস্থাপন করতে হবে। আরজিতে মূল অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম-ঠিকানাসহ কেন, কী কারণে আপনার শান্তি বিনষ্ট করছে এবং কোনো ভয়ভীতি দেখালে কখন ঘটনাটি ঘটেছে তা স্পষ্ট করে লিখতে হবে। আরজির সঙ্গে কোনো প্রমাণ থাকলে তা দাখিল করতে হবে। কোনো সাধারণ ডায়েরি বা জিডি করা থাকলে তা–ও দাখিল করতে হবে।

লেখা পাঠানোর ঠিকানা

অধুনা, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫। ই-মেইল: [email protected], ফেসবুক: facebook.com/adhuna.PA খামের ওপর ও ই-মেইলের subject–এ লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’