কোথায় যেন হারিয়ে গেল মায়ায় ভরা সেই ঈদগুলো

নব্বইয়ের দশক একটা প্রজন্মের কাছে বড্ড স্মৃতিকাতরতার, বড্ড মন কেমন করার।
ছবি : গ্রাফিকস

১৯৯৩ সালে রোজার ঈদ পড়েছিল ২৬ মার্চ।

স্বাধীনতা দিবসের দিন ঈদ! একটু অন্য রকম না? যে দিনটাতে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সশস্ত্র বাহিনীর প্যারেড হয়, ৩২ বার তোপধ্বনি দিয়ে শুরু হয় দিন, সেদিন ঈদ! সত্যিই অন্য রকম। এই ‘অন্য রকম’ ব্যাপার নব্বইয়ের দশকে ঘটেছে আরও একবার। তিন বছর পর। ১৯৯৬ সালের ঈদুল ফিতর হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি।

১৯৯৩ সালের সেই ঈদের কথা খুব মনে আছে। সেই ঈদে আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছিল। মার্চে দিনভর বৃষ্টি—কেউ কখনো দেখেছে? মেঘলা আকাশ নিয়ে শুরু হওয়া দিনটিতে সত্যি সত্যি বৃষ্টি শুরু হলে মনটা ভীষণ দমে গিয়েছিল। তখন যে বয়স, সে বয়সে ঈদের দিন বৃষ্টি মানেই পাড়া বেড়ানোয় বড় বাগড়া। আরও শঙ্কা, বৃষ্টির দোহাই দিয়ে মা–বাবা যদি দিনটি বাড়িতেই কাটিয়ে দিতে বলেন! নাহ্! বৃষ্টি হলেও অতটা নির্দয় মা–বাবা সেদিন হননি।

’৯৬–এর রোজার ঈদে ২১ ফেব্রুয়ারি তো ছিলই, আরও একটি ব্যাপার ছিল। ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ২১ ফেব্রুয়ারির আবেগ, ঈদের আনন্দ, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের রোমাঞ্চ—এমন ঘটনাবহুল দিন জীবনে পরে খুব কমই এসেছে।

নব্বইয়ের দশকের এই দুটি ঈদ এসব কারণেই বিশেষ। আচ্ছা, নব্বইয়ের দশকটাই তো বিশেষ। একটা প্রজন্মের কাছে বড্ড স্মৃতিকাতরতার, বড্ড মন কেমন করার। কিশোর বা যুবা বয়সের সেই উচ্ছ্বাস ভরা দিনের স্মৃতি, যেকোনো বিচারেই অনন্য। সুযোগ পেলেই সেই প্রজন্মের আড্ডার বিষয়, আবেগে ভাসার বিষয়।

স্মৃতিমেদুর নব্বইয়ের দশকের ঈদগুলো আসলেই কেমন ছিল? ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ—কিছুই ছিল না। তারপরও আটপৌরে সেই সময়গুলো খুব করেই মনে পড়ে। তখন প্রথম রমজান থেকেই যেন ঈদ শুরু হয়ে যেত। পাড়ার ছেলেরা মিলে দল বেঁধে তারাবিহর নামাজ পড়তে যাওয়ার নামে বাড়ি থেকে বের হওয়া, মসজিদে একটু ঢুঁ মেরেই দল বেঁধে আড্ডা। লাইলাতুল কদরের রাতে রাতভর ইবাদতের মধ্যেই রাতের শহরে বন্ধুরা মিলে হেঁটে বেড়ানো। ২৭ রোজা থেকেই ঈদের আমেজ। বাড়ির সবাই মিলে ঈদের কেনাকাটা তো হতো আরও আগেই। ঈদের পাঞ্জাবিটা পছন্দ হয়নি বলে কপট অভিমান। এরপর ঈদ পর্যন্ত উৎকণ্ঠা, কে না কে আবার ঈদের নতুন জামা–জুতা দেখে ফেলে! তাহলে তো ঈদের চৌদ্দ আনা আনন্দই মাটি।

ঈদের চাঁদ নিয়ে মনে পড়ে গেল নব্বইয়ের দশকেরই একটা ঘটনা। ১৯৯৮ সালের কথা। ২৯ রমজানে কোথাও ঈদের চাঁদ দেখা গেল না। কিছুটা হতাশই লাগছে। কাল ঈদ হবে না। কিছুক্ষণ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডাবাজি সেরে সবে বাড়ি ফিরেছি। বাড়িতেও সব সুনসান। কাল ঈদ নয় বলে মায়ের মুখে প্রশান্তির ছাপ। তাড়াহুড়ার ঝক্কিটা নিতে হবে না বলেই তিনি আনন্দিত। টেলিভিশনে রাত ১০টার ইংরেজি সংবাদের সিগনেচার টিউন বেজে উঠল। এর পরপরই সবার মাথায় বাজ। যে ঈদের চাঁদ সন্ধ্যায় দেখা যায়নি, সেটিই দেখা গেল রাত ১০টায়। দেশের কোনো এক প্রান্তে ঈদের একফালি চাঁদ উঁকি দেওয়ায় রাত ১০টাতেই ঘোষণা হয়ে গেল পরদিন ঈদ। এরপরের ঘটনাবলি কেমন ছিল, নিশ্চয়ই বলে দিতে হয় না।

নব্বইয়ের দশকের ঈদের সঙ্গে দারুণভাবে জড়িয়ে আছে বিটিভির দুটি অনুষ্ঠান। হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’ আর হুমায়ূন আহমেদের নাটক। বিটিভিতে আরও দুটি জিনিস ঈদের সঙ্গে দারুণভাবে সম্পর্কিত—ঈদের সন্ধ্যায় ব্যান্ড শো আর রাতের আনন্দমেলা। ঈদের রাতে যদি হুমায়ূন আহমেদের নাটক থাকত, তাহলে যেখানেই থাকা হোক না কেন, অবধারিতভাবে বাড়ি ফেরার তাড়া থাকত। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে একসঙ্গে ঈদের নাটক বা ‘ইত্যাদি’ দেখার আনন্দের কোনো তুলনাই হয় না।

একটা ‘ঈদ আনন্দমেলা’র কথা খুব মনে পড়ে। সেটি ১৯৯৩ সালের ঈদুল ফিতরের। স্বাধীনতা দিবসের কারণেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক, সেই আনন্দমেলা প্রচারিত হয়েছিল চাঁদরাতে। সেটি ছিল ২৫ মার্চের রাত। বাঙালির কালরাত। শত শহীদকে স্মরণ করা হয়েছিল তাতে। একদিকে ঈদের আনন্দ, স্বাধীনতা দিবসের গৌরব আর শহীদদের স্মরণ—এমন ঈদ আনন্দমেলা আর কখনো কেউ দেখেনি। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের উপস্থাপনায় সেই আনন্দমেলায় লটারিতে একটি গাড়ি পেয়েছিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা। আবুল হায়াত জিতেছিলেন ঢাকা–ফ্রাঙ্কফুর্ট–ঢাকা বিমান টিকিট। হুমায়ূন আহমেদের রচনায় একটি নাট্যাংশে অয়োময়–এর মির্জা সাহেব (আসাদুজ্জামান নূর) হাতি নিয়ে গাউছিয়া মার্কেটে বাজার করতে গিয়েছিলেন। টেলিভিশনে প্রচারিত একটি ঈদের অনুষ্ঠান আজ এত বছর পরও স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে—নব্বইয়ের দশকের মজাটাই যে এখানে।

ঈদের আনুষঙ্গিক কেনাকাটার মধ্যে কার্ডশপে ঢুঁ মারাটা তখন অবধারিতই ছিল। আজাদ প্রোডাক্টসের তখন খুব রমরমা। তার মধ্যে এসে গেছে একটু অভিজাত উপহারের দোকান ‘আর্চিস’ আর ‘হলমার্ক’। প্রিয়জনদের কথা ভেবে বেছে বেছে কার্ড কিনে তাতে যত্ন করে শুভেচ্ছাবার্তা লেখা…মায়ায় ভরা সেই ঈদগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেল!