এটাই কি বাংলার বাইরে প্রথম শহীদ মিনার?

বাঙালির ভাষা চেতনার প্রতীক শহীদ মিনার। তাই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশীরা এখন তাদের অভিবাসন ভূমিতে গড়ে তুলছেন শহীদ মিনার। বাংলার বাইরে বিশ্বের প্রথম শহীদ মিনার সম্ভবত গড়ে উঠেছে লন্ডনে। এই শহীদ মিনার নির্মাণের ইতিহাসটি তুলে ধরেছেন শামীম আজাদ

লেখাটি ২০০০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র ছুটির দিনেতে প্রকাশিত

ছুটির দিনে ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত সেই শহীদ মিনার
ছবি: প্রথম আলো আর্কাইভ

বিলেতের প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় বৃহত্তর ম্যানচেস্টারের ওল্ডহামে। এখানে প্রায় ৮ হাজার বাঙালির বসবাস (২০০০ সালের তথ্য)। ওল্ডহামে বসবাসরত বাংলাদেশী অভিবাসীদের পূর্বসূরিরা অধিকাংশই আসেন ষাট দশকে কটন ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে। ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেলে এরা বেকারত্বের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে নানারকম পেশায় ও বিলেতের রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন। এ সময় ব্যবসার মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলাদেশী ক্যুজিনের ক্যাটারিং আর রাজনীতিতে স্থানীয় পর্যায়। তৃতীয় প্রজন্ম এসে এই রেস্তোরাঁ ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ শিক্ষা এবং অন্যান্য পেশায় যুক্ত হতে শুরু করে আশির দশকের শেষে।

এ সময়ই এ স্থানে ঘটে একটি মজার পরাগায়ণ। নতুনদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের তাগিদে ও পুরনোদের আত্মসচেতনতা ও জাতীয়তাবোধ থেকে জন্ম নেয় বাংলাদেশের শহীদ মিনারের অনুকরণে ভাষা শহীদ স্মরণ স্তম্ভ তৈরির তাগিদ। প্রবাসে নিজ জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে এরা কাজে নেমে পড়েন। এদের কাজ হয় বহুমুখী। এস্টিমেট, স্থান নির্ণয়, ফান্ড জোগাড়ের জন্য লবিং, নকশা, পরিকল্পনা সবাই। বলতে গেলে ওল্ডহামবাসীর ’৯৫ সালের স্বপ্ন নানান পথ পেরিয়ে গিয়ে বাস্তব রূপ লাভ করে অত্যন্ত কম সময়েই। আর্কিটেকচারাল ডিজাইন করে বিলেতের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান ফ্রি ফর্ম আর্ট’স ট্রাস্ট এবং নভেম্বরের শেষে বিলেতের বিখ্যাত নির্মাতা জে আর অ্যান্ড সি ব্রুকলির তত্ত্বাবধানে ছয় মাসে শেষ হয় এর নির্মাণ কাজ। ১৯৯৭-এর অক্টোবরে করা হয় এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। নকশা করা হয়েছে হুবহু ঢাকার শহীদ মিনারের মতো। সামনে খোলা চত্বর ও সিঁড়ি।

এ শহীদ মিনার নির্মাণে যারা বিশেষ অবদান রাখেন তারা হলেন কাউন্সিলার আব্দুল জব্বার, আব্দুল করিম, সয়ফুল আলম, মুহিবুর রহমান, কাসিনো, এ্যান থ্যাকার ও ওয়েন জোন এবং সংগঠন হিসেবে ওল্ডহাম বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন ও ওল্ডহাম বাংলাদেশ মহিলা অ্যাসোসিয়েশন।

১৯৯৮-এর ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় এখানে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও ভাষা শহীদদের স্মরণে নানা অনুষ্ঠান। বৃহত্তর ম্যানচেস্টার থেকে আসে বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন ও মানুষ। বাংলাদেশের মাটিতে যাদের এবং এই নতুন প্রজন্মের শেকড় তারা গেয়ে ওঠে সেই একটি মানুষের গান। যার নাম আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। ধ্বনিত হয় শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুর। এই প্রবাসে।

এ দেশে বড় হওয়া বর্তমান প্রজন্মের অক্লান্ত চেষ্টায় একই প্রক্রিয়ায় এখন শহীদ মিনারের সামনে নির্মিত হচ্ছে (২০০০ সালে) শাপলা পুকুর। দ্রুত চলছে কাজ। সকলের আশা এ কাজ একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই শেষ হবে আর বাংলাদেশী স্থায়ী স্থাপত্যকর্ম হিসেবে শোভা পাবে দুই রাস্তার সংযোগস্থানে খোলা জায়গায়। বিলেতের মানুষ তখন শুধু ফেব্রুয়ারি নয়, বছরের যেকোনো দিন এদিক পেরিয়ে যেতে যেতে শাপলা চত্বর দেখে থমকে দাঁড়াবে। পড়বে বাংলাদেশের মানুষের ভাষার জন্য আত্মত্যাগের কাহিনী।

লন্ডনের শহীদ মিনারটি স্থাপন করার স্থান প্রসঙ্গে নানা প্রস্তাব উঠলেও টাওয়ার হ্যালেটস বারার বাঙালি কাউন্সিলারদের অনমনীয় মনোভাবের জন্য কাউন্সিল শেষ পর্যন্ত তা আলতাফ আলী পার্কে দিতে সম্মত হয়। আলতাফ আলী পার্ক প্রবাসী বাঙালির আরেক গর্বের ইতিহাস।

১৯৯৮ সালে বিলেতে বর্ণদাঙ্গা তুঙ্গে। তখন ব্রিকলেনের অপর মাথা যেখানটায় লেগেছে গিয়ে বেথনাল গ্রিন রোডে, সেখানেই ছিল চরমপন্থী দল ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টি বিএনপির প্রচার কেন্দ্র। দিনরাত ব্রিকলেন থেকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। সুযোগ পেলেই শ্বেতাঙ্গ স্কিন হেডরা এসে ব্রিকলেনে ঢুকে বাঙালি রেস্তরাঁর দরজা-জানালা ভেঙে চুরমার করে দিয়ে যাচ্ছে। লন্ডনে মাইকেল ফেরিয়ার নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে হত্যা করেছে। তাই এলাকা ছাড়িয়েও উত্তেজনা বাড়ছে সারা শহরে। বর্ণবাদের অভিযোগ উঠছে পুলিশের বিরুদ্ধে। তখন স্থানীয় তরুণরা হয়ে ওঠেন সংঘবদ্ধ। নিজেরাই স্কোয়াড গঠন করে পালাক্রমে পাহারা দিতে থাকেন।

ব্রিকলেনের এদিকে ওসবোর্ন স্ট্রিট এসে লেগেছে হোয়াইট চ্যাপেল রোডে। ডান হাতে অলগেট ইস্ট টিউব স্টেশন। শীতের শেষ। রাস্তার অপর দিকে মাতাল ও ভবঘুরেদের স্থান ‘ব্যাডি পার্ক’ বলে পরিচিত ছোট্ট খোলা জায়গায় সবে গাছের শাখায় ফুটতে শুরু করেছে পাতা। পাশ দিয়ে গেছে সরু অ্যাডলার স্ট্রিট। এখানেই কাজ থেকে ফেরার পথে বাইশ বছরের ঝাঁকড়া চুলের যুবক আলতাফ আলীকে একা পেয়ে তিনজন বর্ণবাদী আক্রমণ করে। নিহত হন আলতাফ আলী। তার মৃত্যুতে বাঙালি কমিউনিটিতে তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। গড়ে ওঠে আলতাফ আলী অ্যাকশন কমিটি। জনাব মরহুম ফখরুদ্দিন, অসুস্থ তাসাদ্দুক আহমদ (এখন মৃত), এদের সক্রিয় উদ্দীপনায় সুদৃঢ় হয়ে ওঠে বাঙালি তরুণ সংগঠন ও নেতৃত্ব। ইয়ুথ ফ্রন্ট, প্রগ্রেসিভ অর্গানাইজেশন ও আলতাফ আলী অ্যাকশন কমিটি একযোগে কাজ করতে থাকে। সুরক্ষিত হয় ব্রিকলেন। বাঙালিদেরই দাবি প্রতিবাদ উদ্যোগে পার্কটির নামকরণ করা হয় শহীদ আলতাফ আলী পার্ক।

সেদিনের সেই তরুণরা অনেক পথ পেরিয়ে আরো পরিণত হয়ে স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে অনেকেই হলেন কাউন্সিলার। কাউন্সিলের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেয়ারে বসলেন। সুযোগ এল বাঙালির। এদিকে বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন সংগঠন হিসেবে হয়ে উঠেছে সুশক্ত। তারা অন্যান্য সামাজিক, রাজনৈতিক, স্বেচ্ছাসেবী ও সাংস্কৃতিক সংস্থা এবং সংগঠনের সঙ্গে একযোগে আলতাফ আলী পার্কেই শহীদ মিনার স্থাপনের দাবি তুললেন। দিলেন আর্থিক নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি। শুরু হলো কাজ, নকশা। প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে এবার কাজ শুরু করল ফ্রি ফর্ম আর্টস ট্রাস্ট। স্থপতি ছিল কমিউনিটি আর্টস অ্যান্ড আর্কিটেকচার ও টাওয়ার হ্যামলেটস ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকটস। মূল শহীদ মিনারের অনুকরণে  নকশা করেছেন আর্টস ফ্যাব্রিকেশন লি. ওয়ার উইক এবং চত্বর নির্মাণ করেছেন আইডবি–উ মনরো কনস্ট্রাকশন লি.। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হলো আটানব্বইয়ের একুশের প্রথম লগ্নে। আর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলো গত বছর ১৯৯৯ সালের একুশেতে।

গত শতাব্দীর শেষে নতুন শতাব্দীর অঙ্গীকার নিয়ে বিগত একুশের মধ্যরাতে বারোটা এক মিনিটে গভীর শীত উপেক্ষা করে হাজারখানেক বাঙালি লন্ডনের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে মিনার পাদদেশে একত্রে গেয়ে উঠেছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘অমর গান’ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’। আলতাফ আলীর নাম একাকার হয়ে গিয়েছিল বরকত, জব্বার ও রফিকের সঙ্গে। রচিত হয়েছিল বিশ্ব মানচিত্রে দর্শনীয় স্থান হিসেবে প্রবাসে বাঙালির আরেক অহঙ্কারের স্তম্ভ।