স্থানীয়দের স্বনির্ভর করতে মাদারীপুরের তরুণদের উদ্যোগ
জয় মল্লিক স্নাতক শেষ করে চাকরি খুঁজছিলেন। এমন সময় ফেসবুকে বিনা মূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের প্রচারণা দেখে আবেদন করেন। তিন মাসের সেই কোর্স করে জয় এখন ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটে ডেটা এন্ট্রির কাজ করে নিজে চলার মতো উপার্জন করছেন।
দেশে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ নতুন কিছু নয়। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এমন অনেক প্রশিক্ষণই চলেছে। তবে মাদারীপুরের মতো জেলা শহরে অ্যাকশন কন্ট্রিবিউটিং টু ট্রান্সফরমেশন (অ্যাক্ট) ফাউন্ডেশনের উদ্যাগটি স্কুলপড়ুয়া থেকে স্নাতক পাস তরুণদের জীবনে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলেছে।
জয় মল্লিক গত বছরের শেষ দিকে অ্যাক্ট ফাউন্ডেশনের কোর্স করেছিলেন। তাঁর মতো এখানে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ২০০–এর বেশি শিক্ষার্থী বেসিক কম্পিউটার কোর্স, গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং ও ইংরেজির কোর্স করেছেন।
মাদারীপুর পৌর ভবনের একটি কক্ষে চলে এসব প্রশিক্ষণ, যা ‘রূপান্তর আইসিটি ল্যাব’ নামে পরিচিত। এতে একসঙ্গে ২২ জন প্রশিক্ষণ নিতে পারে।
স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মেহেরুন্নিসার অনলাইনভিত্তিক একটি ছোট্ট ব্যবসা আছে। পাশাপাশি বিদেশেও পড়তে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর। তাই ইংরেজিটা ভালো করে শিখতে চান তিনি। অ্যাক্ট ফাউন্ডেশনের রূপান্তর আইসিটি ল্যাবে এসে স্পোকেন ইংলিশ শিখছেন মেহেরুন্নিসা।
আবার সপ্তম শ্রেণির মাহতাব আহমেদের বাসায় কম্পিউটার রয়েছে। কিন্তু সেটার যথাযথ ব্যবহারের জন্য বেসিক কম্পিউটার শিখতে এসেছে এই ফাউন্ডেশনে।
মাদারীপুরের তিন স্কুলবন্ধু ইসতিয়াক আহমেদ শাওন, নাজমুল ইসলাম সেরনিয়াবাত ও চৌধুরী ফকরুল আলমের উদ্যোগে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এ ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁদের সঙ্গে সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যুক্ত হন মেহেদী হাসান ও মশিউর রহমান।
উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই কর্মসূত্রে মাদারীপুরের বাইরে থাকেন। তাই ফাউন্ডেশন পরিচালনায় যুক্ত স্থানীয় তরুণেরা, যাঁদের অনেকেই এখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
আগ্রহী শিক্ষার্থীরা এখানে আবেদন করে পছন্দের কোর্সে ভর্তি হওয়ার জন্য। এরপর যাচাই-বাছাইয়ের পর তাঁদের এখানে নেওয়া হয়। প্রতিটি কোর্সই তিন মাসের।
ল্যাবভিত্তিক কার্যক্রমের বাইরেও ‘স্বপ্ন চাকা’ নামে অ্যাক্ট ফাউন্ডেশনের আরেকটি উদ্যোগ রয়েছে। এ উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় দরিদ্রদের উপার্জনে সহায়তা করার জন্য রিকশা দেওয়া হয়েছে। শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে অনুদান হিসেবে পাওয়া জাকাতের অর্থ থেকে ১৫ জনকে ব্যাটারিচালিত রিকশা দেওয়া হয়েছে গত জুনে।
ইট ভেঙে, ভাড়ায় রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন মোহসিন উদ্দিন। যেদিন যে কাজ পেতেন, সেটাই করতেন। স্বপ্ন চাকার আওতায় তিনিও চলতি বছরের জুনে একটি রিকশা পেয়েছেন। এখন আর তাঁকে কাজ খুঁজতে হয় না। দিনে গড়ে ৮০০ টাকার মতো আয় হয়।
অ্যাক্ট ফাউন্ডেশন বলেছে, এই রিকশাগুলো চালকদের একেবারেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁরা যাতে এগুলো বিক্রি না করে দেন, সে জন্য একটি চুক্তি করা হয়েছে। পাশাপাশি রিকশার প্রতি যেন একটি দায়বদ্ধতা থাকে, সে জন্য প্রতিদিন ফাউন্ডেশনের কাছে ১৫০ টাকা জমা রাখতে হয়। যে টাকার ৫০ টাকা থাকে রিকশায় কোনো সমস্যা হলে তা সারাইয়ের জন্য এবং ১০০ টাকা রাখা হয় নতুন কোনো রিকশা কেনার জন্য। অর্থাৎ তাঁদের টাকা দিয়েই নতুন রিকশা কিনে তাঁদের মতো কাউকে সাবলম্বী করা হবে।
ফাউন্ডেশনটি করার উদ্যোগ প্রসঙ্গে এর প্রেসিডেন্ট ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘চাকরি পেতে গেলে কর্মজীবনে ডিজিটাল দক্ষতা লাগবেই। এ ছাড়া ডিজিটাল লাইফস্টাইল এখন জীবনের অংশ। সে চিন্তা থেকেই আইসিটি ল্যাব করা হয়েছে। বড় শহরের নানা সুযোগ থাকলেও জেলা শহরগুলোতে এখনো স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল দক্ষতায় পিছিয়ে। শুধু স্মার্টফোন চালানোই নয়, এর পাশাপাশি এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে যাতে তারা নিজেদের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারে, সে চেষ্টা করছে অ্যাক্ট ফাউন্ডেশন। আমাদের উদ্যোগে সহযোগী হিসেবে রয়েছে সানাবিল ফাউন্ডেশন। বড় পরিসরে কাজ করতে সমাজসেবা কার্যালয়ে নিবন্ধনের আবেদন করেছি আমরা।’
শুধু প্রশিক্ষণ দিয়ে ছেড়ে দেওয়াই নয়, শিক্ষার্থীরা চাইলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান আরেকজন উদ্যোক্তা নাজমুল ইসলাম।
উদ্যোক্তারা জানান, খুব শিগগির ফাউন্ডেশন থেকে স্থানীয় নারীদেরও সাবলম্বী করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের সেলাই মেশিন কিনে দেওয়া হবে। পাশাপাশি এই নারীদের অনলাইনে পোশাক বিক্রির বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেবে তারা।