কুড়িয়ে পাওয়া ১৮ লাখ টাকা নিয়ে যে বিপদে পড়েছিলাম

৬ আগস্ট থেকে ‘সেভ রাজশাহী’ প্ল্যাটফর্মের আওতায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণসহ নানা ধরনের সেবামূলক কাজ করেছেন কয়েক শ তরুণ। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই এক ব্যাগ টাকা কুড়িয়ে পায় স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল। ব্যাগে ছিল প্রায় ১৮ লাখ টাকা। সেই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো, মনজুরুল আলমকে তা–ই শোনালেন দলের অন্যতম সদস্য মাহফুজুর রহমান

কুড়িয়ে পাওয়া টাকা নিয়ে বোয়ালিয়া থানায়
ছবি: প্রথম আলো

১৮ আগস্ট। রাজশাহীর ভদ্রা মোড়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছিলাম আমরা কয়েকজন। রাত তখন প্রায় শেষ। গাড়ির চাপ একদমই কম। তেমন একটা কাজ নেই বলে দলের আকাশ বিন ওসামা ও আরমান গলির মধ্যে হাঁটছিল। হাঁটতে হাঁটতেই আকাশ দেখে একটি বাড়ির সামনে একটা ব্যাগ পড়ে আছে। তারা প্রথমে ভেবেছিল, পরিত্যক্ত কোনো ব্যাগ। কৌতূহলবশে ব্যাগে লাথি মারতেই বোঝা গেল, ভেতরে কিছু আছে। ব্যাগ খুলতেই চক্ষু চড়কগাছ—এ যে টাকার বান্ডিল, সব হাজার টাকার নোট!

টাকাভর্তি ব্যাগ পাওয়ার খবর আমাকে জানাতেই মিনিট দশকের মধ্যে ভদ্রা মোড়ে পৌঁছে যাই। ভোর সাড়ে ৫টা বাজতে বাজতে আমরা ১৫ জন হয়ে যাই। এগুলো কার টাকা? এত টাকা নিয়ে কী করব? টাকা ঘিরে বসে এসবই ভাবতে থাকি সবাই। বুদ্ধিপরামর্শের জন্য (শাটিকাপ ও সিনপাটখ্যাত পরিচালক মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম) শায়িক ভাইকে ফোন করি। ভাই বললেন, টাকাটা ডিসি (জেলা প্রশাসক) অফিসে জমা দিয়ে দাও।

দলের সাদ নামে একজন তার বাবা পারভেজ রায়হানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পারভেজ আঙ্কেল রাজশাহী ডিসি অফিসের সাবেক কর্মকর্তা। তখনই ঘটনাস্থলে চলে আসেন আঙ্কেল। সব শুনে জানালেন, ডিসি অফিসে না, আগে থানায় জিডি করতে হবে। তখন নতুন সমস্যা দেখা দিল। আমরা কোন থানায় জিডি করতে যাব! কারণ, টাকার ব্যাগটা ভদ্রা মোড়ের এমন এক জায়গায় পেয়েছি আমরা, যেটি মতিহার, বোয়ালিয়া ও চন্দ্রিমা থানার বর্ডারে পড়েছে। তাহলে কোন থানায় যাব আমরা! অনেক আলাপ আলোচনার পর ঠিক হলো বোয়ালিয়া থানায় যাওয়া হবে। 

আরও পড়ুন

সকাল ৬টার দিকে আমরা বোয়ালিয়া থানায় চলে যাই। কয়েকজন সেনাসদস্য তখন থানা পাহারা দিচ্ছিলেন। ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) সাহেব থানায় ছিলেন না, ছিলেন সাধারণ পোশাকের কয়েকজন পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে জানা গেল, ওসি সাহেব বেলা ১১টার দিকে আসবেন। এতক্ষণ বসে থাকতে হবে? আমাদের সমস্যাটা পুলিশদের বুঝিয়ে বলি। তাঁরা ফোন করে ওসিকে জানালে তিনি আসতে রাজি হন। 

এই ফাঁকে আমরা টাকা গোনা শুরু করি। গোনার পর দেখি—একবার ১৭ লাখ ৯৫ হাজার হয়, আরেকবার ১৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা। সে সময় টাকাসহ আমাদের ছবি তোলা হয়। এর মধ্যে ওসি সাহেব এসে পড়েন, আমাদের কাজের প্রশংসা করেন। তাঁর পরামর্শে আমরা জিডি করি। এরপর জটিলতা দেখা দিল, টাকাটা কোথায় রাখা হবে!

ওসি সাহেব জানালেন, টাকা থানাতেই জমা দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু থানা-পুলিশের নিজেরই তো তখন নিরাপত্তা নেই। এ অবস্থায় ওসি সাহেব জানালেন, একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে আগে টাকা গোনাতে হবে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোন দেওয়া হলো। তিনি জানালেন, তাঁর আসতে ঘণ্টা দুই লাগবে। 

ততক্ষণে ১০টা বেজে গেছে। আরও দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে! সময়টা আমাদের কাছে বড় দীর্ঘ মনে হতে থাকল। দ্রুত টাকা জমা দিয়ে আমরা দায়মুক্ত হতে চাইছিলাম। সঙ্গে থাকা পারভেজ আঙ্কেল তখন ডিসি অফিসে তাঁর পরিচিত আরেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কথা বললেন। 

ঠিক হলো থানা থেকে আমরা কোর্টে যাব। তখন আরেক বিপত্তি দেখা দিল। টাকার সঙ্গে একটি কাপ ছিল। দেখলে মনে হয় সোনার তৈরি। পরে পরীক্ষা করে দেখা গেল, ওটা সোনার না। সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের সহায়তায় এগিয়ে এলেন। টাকার ব্যাগ নিয়ে তাঁদের সঙ্গেই কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গেলাম। কী করবেন, ম্যাজিস্ট্রেট নিজেও বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কারণ, দেশের এই টালমাটাল অবস্থায় কোর্টের ভল্টও অরক্ষিত। সেখানে টাকা রাখা নিরাপদ নয়।

আবার টাকা নিয়ে শুরু হলো দোটানা। 

তখনো আমাদের কারও সকালের নাশতা হয়নি। উপায়ান্তর না দেখে আমরা আরও আধা ঘণ্টা কোর্টে বসে থাকলাম। এর মধ্যে একটি পত্রিকার অনলাইনে আমাদের টাকা পাওয়ার খবর বেরিয়ে গেছে। সেই খবর পড়ে পরিচিত অনেকেই ফোন দেওয়া শুরু করল। কেউ কেউ আবার জানতে চাইল, কত টাকা পকেটে ভরেছি! মজা করে তাঁদের বললাম, আয় ভাগ নিয়ে যা! আশা ছিল কেউ ভাগ নিতে এলে অন্তত সকালের নাশতার টাকাটা তাঁর কাছ থেকে আদায় করব। সেই সঙ্গে মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে, পরিচিত মানুষই যদি সন্দেহ করে, তাহলে অন্যরাও তো পরে বিতর্ক তুলতে পারে। তাই দ্রুত বিষয়টার নিষ্পত্তি করা দরকার। 

একপর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের জানালেন, একবার টাকা ভল্টে রাখলে পরে দাবিদার এলেও আর ফেরত দেওয়া যাবে না। তাই ফেরতের সুযোগ রাখতে হবে। কোর্টের এক পুলিশ অফিসারও তা–ই বললেন, এভাবে কোষাগারে টাকা রাখার নিয়ম নেই। পরে কেউ অর্থ দাবি করলে ফেরত দেওয়া লাগতে পারে। 

তখন ঠিক হলো, টাকাটা ব্যাংকে রাখা হবে। সেখানেও ভল্ট আছে। পাশেই সোনালী ব্যাংক। পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে এবার আমরা সেখানে গেলাম। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মালিকানাবিহীন টাকা ভল্টে রাখতে রাজি না। রাখতে হলে আমাদের কারও নামে অ্যাকাউন্ট খুলে রাখতে হবে। সেধে এই গুরুদায়িত্ব আমরা কেউ নিতে চাইলাম না। সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রস্তাব করলাম টাকাটা তাঁদের নামে রাখা হোক। কিন্তু তাঁরাও আইনগতভাবে সেই দায়িত্ব নিতে চান না। সময় গড়িয়ে যায়। পুলিশের পরামর্শে এরপর আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে যাই। 

জেলা প্রশাসক সাহেব আমাদের সব কথা শুনে ট্রেজারিতে টাকা রাখার আশ্বাস দেন। তবে ট্রেজারিতে টাকা রাখতেও কোর্টের আদেশপত্র লাগবে। তখন বাজে বেলা তিনটা। শেষমেশ আরও দুই ঘণ্টা পর বিকেল সোয়া ৫টায় কোর্টের আদেশ পাই। ডিসি অফিসের ট্রেজারিতে জমা হয় টাকা। জমার চালান পেতে আরও ২৫ মিনিট চলে যায়। ৬ মাসের মধ্যে কেউ দাবি না করলে টাকাগুলো এখন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়ে যাবে। 

সকাল ছয়টায় শুরু হয়েছিল কুড়িয়ে পাওয়া টাকা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ। সেই টাকা জমা দেওয়ার অবিশ্বাস্য জার্নি শেষ হতে হতে লেগে গেল পাক্কা ১২টা ঘণ্টা। দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকেই বলছিলেন, এত অল্প সময়ে সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দেওয়ার ঘটনা নাকি এটাই প্রথম!