‘এই সময়টাতেই আমি হলের পেছনের দরজা দিয়ে পালাই, যেন দর্শক আমাকে তাড়া করতে না পারেন’

আজ বিখ্যাত পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের জন্মদিন। তাঁর ওপেনহাইমার সিনেমাটি এখন সারা বিশ্বেই আছে তুমুল আলোচনায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ডে-তে ২০১৫ সালে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। সেই বক্তৃতা থেকে মেধাবী এই নির্মাতার ভাবনার জগৎ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

ক্রিস্টোফার নোলান।
ছবি: রয়টার্স

আমি পড়েছি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে। কলেজের শিক্ষা আমার বাকি জীবনের ওপর প্রভাব ফেলেছে। কলেজ আমার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা একটু বলে নেওয়া দরকার। আমার স্ত্রী এমা আজ এখানে আমার সঙ্গে আছে। সে শুধু আমার সহধর্মিণীই নয়, আমার ছবির প্রযোজকও। কলেজের প্রথম দিনেই এমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল! (হাসি) এরপর আমরা একসঙ্গে নয়টি ছবি ও চারটি সন্তান জন্ম দিয়েছি। অথবা নয়টি সন্তান ও চারটি ছবিও বলা যায়...মাঝেমধ্যে গুলিয়ে ফেলি!

এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তোমরা নানা ঘটনার সম্মুখীন হবে। কিছু চমৎকার, কিছু অভিজ্ঞতা হবে হয়তো তিক্ত। কিন্তু তুমি যা নিয়ে যাচ্ছ, তার ওপর নির্ভর করছে তুমি সামনের চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করবে। তোমরা যে শুধু জ্ঞান অর্জন করেছ তা নয়। তোমরা শিখেছ, কীভাবে শিখতে হয়। তোমরা জেনেছ শেখার গুরুত্ব। ২০ বছর আগে আমি যেমন ছাত্র ছিলাম, এখন আমি তার চেয়েও মনোযোগী ছাত্র। প্রতিদিন নতুন কিছু শিখছি। তোমার শেখায়-জানায় কিছু কিছু ফাঁক থেকে যাবে। সেই ফাঁকা জায়গাগুলো পূরণ করবে তোমারই নতুন কোনো ভাবনা। যে ভাবনা হয়তো পৃথিবী বদলে দেবে।

আমার বক্তব্য হলো, বাস্তবতাকে সম্মান করো। আমার মনে হয় বিগত বছরগুলোতে আমরা বাস্তবতাকে আমাদের স্বপ্নের ‘দরিদ্র কাজিন’ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছি। যেন চারপাশে রঙিন স্বপ্নের অবয়বগুলোর মাঝখানে বাস্তবতা একটা ধূসর, মলিন কিছু। অথচ যেই ‘ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি’ আমাদের ঘিরে রেখেছে, সেটা তো বাস্তবতারই অংশ।
ইনসেপশন ছবিতে এ রকম একটা কিছুই বলতে চেষ্টা করেছি। যারা ছবিটি দেখোনি, তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, কারণ আমি শেষ দৃশ্যের মজাটা নষ্ট করে দিচ্ছি। ছবির শেষে একটা লাটিম ঘুরতে দেখা যায়। লাটিমটা পড়ে যাবে কি যাবে না, তার ওপর নির্ভর করছে সময়টা বাস্তব না স্বপ্ন। ছবির চরিত্র লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও তার সন্তানদের কাছে ছুটে যায়। লাটিমটা ঘুরতেই থাকল না পড়ে গেল, তাতে তার আর কিছু যায় আসে না। ক্যামেরা আস্তে আস্তে লাটিমের ওপর এসে থামে। লাটিমটা যখন ঘুরতে ঘুরতে টালমাটাল হয়ে যায়...তখনই পর্দা অন্ধকার হয়ে আসে। এই সময়টাতেই আমি হলের পেছনের দরজা দিয়ে পালাই, যেন দর্শক আমাকে তাড়া করতে না পারেন! বেশির ভাগ দর্শকই ছবি শেষে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান। তাঁরা জানেন এটা একটা সিনেমা, একটা ‘ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি’, তবুও। এটাই ‘বাস্তব’ জীবনের মজা। বাস্তবতার প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। অস্কার ওয়াইল্ড একবার বলেছিলেন, বুড়োরা সবকিছু বিশ্বাস করে, মধ্যবয়স্করা সবকিছুকে সন্দেহ করে আর তরুণেরা সবকিছু জানে! তোমরা সব জানো। আমি নিশ্চিতভাবেই এখন সন্দেহবাতিকগ্রস্ত পর্যায়ে আছি। এবং আমি চাই তোমরাও কিছু কিছু বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করো, ঘটনার মূলে যেতে চেষ্টা করো।
বক্তৃতার ‘নিয়ম’ হলো সমাধান না বলে সমস্যাগুলো বলা। আর এ ধরনের বক্তৃতায় সাধারণত লোকে মুখ গম্ভীর করে বলে, ‘তোমার স্বপ্নের পেছনে ছোটো।’ আমি এমন কিছু বলব না। কারণ কথাটা আমি বিশ্বাস করি না। স্বপ্ন বা বাস্তবতা, কোনোটাকেই আমি তাড়া করতে বলব না। শুধু বলব, বাস্তবতাকে তোমার স্বপ্নের ভিত হিসেবে দেখো। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা তোমাকে যা দিয়েছে, সেটা কাজে লাগানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করো। যে ক্ষেত্রেই তুমি কাজ করো না কেন, খুব গভীরভাবে লক্ষ রাখো, তোমার কাজ মানুষের মধ্যে কী পরিবর্তন আনছে। আমি বিশ্বাস করি, তোমাদের প্রতিভার কোনো সীমা নেই।
ব্যাটম্যান কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে, সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু ব্রুস ওয়েইন সম্পর্কে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সবাই ভুলে গেছে। হ্যাঁ, ব্যাটম্যানও প্রিন্সটনের ছাত্র ছিল, কিন্তু সে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারেনি। অতএব আগামীকাল থেকে, তোমরা প্রত্যেকেই ব্যাটম্যানের চেয়েও উত্তম! (সংক্ষেপিত)