কেউ গরু বিক্রি করে, কেউবা চাল–ডাল নিয়ে ঢাকায় এসেছেন কোচিং করতে

এই দুই শিক্ষার্থী ঢাকায় এসেছেন কুমিল্লা থেকে। তাঁদের মতো অনেকেই ভিড় করছেন ফার্মগেটের কোচিংপাড়ায়।
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

কোচিংয়ে-কোচিংয়ে ঠোকাঠুকি। দেয়ালগুলো প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে সাইনবোর্ড, ব্যানার, পোস্টারে। কোন ভবনে কোন কোচিং সেন্টার, বোঝা দায়। ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা পড়ান, তাঁদের আছে ছোট ছোট কামরা। একটা দরজা মিস হলেই আপনি হয়তো কামরুল স্যারের ফিজিকস ক্লাসের বদলে সোহেল স্যারের অর্থনীতি ক্লাসে ঢুকে পড়বেন। অতএব স্যারদের ব্যাচে পড়তে গিয়ে প্যাঁচে পড়াই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন

ফার্মগেটের কোচিংপাড়ার এই হলো চেনা দৃশ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মৌসুমে এলাকাটা আরও রমরমা হয়ে ওঠে। তবে এত হট্টগোলের ভিড়েও কিছু স্বপ্নিল চোখ আপনার চোখে পড়বে। বয়স ১৬ কি ১৭। কৈশোর এবং তারুণ্যের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে একদল ছেলে, মেয়ে। কেউ কেউ দল বেঁধে আড্ডা দেন। কারও কারও চাহনিতে আবার একটু ইতস্তত ভাব। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই প্রথমবারের মতো গ্রাম ছেড়ে, মা-বাবাকে ছেড়ে ঢাকায় এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন পুরোদমে। তাঁদের সঙ্গে আলাপ করতেই ১৮ জানুয়ারি হাজির হয়েছিলাম ফার্মগেটের কোচিংপাড়ায়।

আরও পড়ুন

নতুন ঠিকানা

সাইয়েদ বিন আবদুল্লাহ আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। বলে রেখেছিলাম, তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আশপাশটা ঘুরব। আবদুল্লাহকে সঙ্গী করার কারণ শুধু এই নয় যে তিনি এখানকার একটা কোচিং সেন্টারে পড়ান বা এলাকাটা তাঁর পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের স্নাতক এই তরুণ ২০১৭ সালে ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে আবদুল্লাহ নিশ্চয়ই তাঁর সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করবেন। সেসব কথাও শোনার ইচ্ছা ছিল।

শুরুতে আলাপ হলো একজন বাবার সঙ্গে। বাড়ি টাঙ্গাইলে। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, ‘টুকটাক ব্যবসা করি।’ ছেলেকে ফার্মগেটের একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়েছেন তিনি। ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় একটা ঘর সাবলেট নিয়েছেন চার মাসের জন্য। মা আর ছেলে থাকে সেখানে। বাবাও আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন। বলছিলেন, ‘ছেলেমেয়েদের একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে হলে এটুকু কষ্ট তো করতেই হবে। বড় মেয়ের সময়ও একইভাবে ঢাকায় সাবলেট থেকেছিলাম। সে এখন একটা বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ে।’

ফার্মগেটের কোচিং সেন্টারগুলো ঘিরে গড়ে উঠেছে রমরমা হোস্টেল–বাণিজ্য। বড় রাস্তার আশপাশ দিয়ে যেসব গলি ভেতরে ঢুকে গেছে, সেখানে ঢুঁ মারলেই দেখবেন, প্রায় সব কটি ভবনেই ‘সিট ভাড়া’লেখা বিজ্ঞাপন সাঁটানো। সাইয়েদ বিন আবদুল্লাহ বলছিলেন, ‘হোস্টেলগুলোর পরিবেশ একদমই ভালো না। আমার সময় আমি উত্তরায় এক আত্মীয়ের বাসায় থাকতাম। ফার্মগেট থেকে দূরত্ব তো কম না। ঢাকার যানজটকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। বাসে যাওয়া-আসার পথেই আমার অর্ধেক পড়া হয়ে যেত। ছোট বোন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য ঢাকায় এল, ও তখন ফার্মগেটের একটা হোস্টেলে কিছুদিন ছিল। বেশি দিন টিকতে পারেনি। হোস্টেল ছেড়ে অনলাইনে কোচিং করেছে।’

ফার্মগেটের কোচিংগুলো ঘিরে জমে উঠেছে জমজমাট হোস্টেল বাণিজ্য।
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ঢাকার বাইরে থেকে এসে অনেকে ফার্মগেটে ঘর ভাড়া করে থাকেন। দল বেঁধে এলে একটু সুবিধা হয়। দুই বান্ধবী সানজিদা জ্যোতি ও খাদিজাতুল জান্নাত যেমনটা করেছেন। বরগুনা থেকে এসেছেন তাঁরা। মেডিকেলে ভর্তির কোচিং করছেন। শুরুতে দুজন মিলে তেজগাঁওয়ে একটা ঘর ভাড়া করে থাকতেন। পরে দেখলেন, দুজনের এই সংসার সামলাতেই দিনের অনেকটা সময় চলে যায়, পড়ালেখা আর করা হয় না। তাই বাড়ি থেকে সানজিদার মা-ও চলে এসেছেন। এখন তিনজন মিলে থাকেন। কেমন লাগে? সানজিদা হেসে বলেন, ‘সারা জীবন গ্রামে থাকসি। পুকুরে গোসল করসি, খেলাধুলা করসি। এইখানে তো সারা দিন এক ঘরে বন্দী। কখন রাত হয়, কখন দিন হয়, ঘড়ির দিকে না তাকাইলে টের পাই না। তারপরও কষ্ট করতেসি। কারণ, ঢাকায় একটা প্রতিযোগিতা আছে। পড়াশোনার চাপ আছে। গ্রামে তো সেইটা নাই।’জ্যোতি-জান্নাতদের এই বদ্ধকুঠুরির ভাড়াও ১১ হাজার টাকা। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, ভাড়া মেটাতেই হিমশিম খেতে হয়। তাই চাল-ডাল সব বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছেন তাঁরা। মাঝেমধ্যে দুই বান্ধবী মিলে দরদাম করে টমেটো কেনেন, নতুন শহরে এটুকুই তাঁদের ‘অভিযান’।

টিকে থাকার, টিকে যাওয়ার লড়াই

ফার্মগেটের এপার-ওপার ঘুরে ঘুরে প্রায় পঁচিশজনের সঙ্গে কথা হলো। একেকজনের টানাপোড়েন একেক রকম। শাকিল (ছদ্মনাম) নামের এক ছাত্র যেমন চাচার বাসায় থেকে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আলাপের একপর্যায়ে প্রশ্ন করলাম, ‘সকালে নাশতা কী খেয়েছেন?’

‘চা-বিস্কিট,’ উত্তর এল।

‘শুধু চা-বিস্কিট?’

‘চাচার বাসায় সকালে সবাই এটাই খায়,’ বলতে বলতে কান্না চাপলেন তিনি। মনে হলো আরও কিছু বলার ছিল। কিন্তু বলবেন কি না, বুঝে উঠতে পারছেন না। শাকিলের বাবা একজন কৃষক। ১২ হাজার টাকা হাতে দিয়ে ছেলেকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন। এই টাকার মধ্যেই কোচিংয়ের খরচ, যাওয়া-আসা, সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করতে হচ্ছে তাঁকে।

গ্রাম থেকে এসে যাঁরা ফার্মগেটে থাকছেন, কোচিং করছেন, তাঁদের একটা বড় অংশই দরিদ্র ঘরের সন্তান। একাধিক কোচিং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, করোনাকালের পর থেকে ঢাকায় এসে কোচিং করার প্রবণতা অনেকটা কমেছে। অনেক শিক্ষার্থী এখন বাড়ি থেকেই অনলাইনে কোচিং করেন। পরীক্ষার আগে কোচিং সেন্টারে গিয়ে শুধু ‘মডেল টেস্ট’ দেন। জেলা শহরগুলোতে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের শাখা গড়ে উঠেছে। স্থানীয় শিক্ষকেরা তো আছেনই; সপ্তাহে দু-একদিন বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গিয়েও ক্লাস নেন। তাই ভর্তি পরীক্ষার্থীদের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা কমছে। সাইয়েদ বিন আবদুল্লাহ বলছিলেন, ‘আমিও মনে করি বাড়িতে থেকে প্রস্তুতি নেওয়াই ভালো। এখানে কষ্ট করে থেকে, খেয়ে না খেয়ে যদি পরীক্ষার আগে একজন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে তো আরও বিপদ।’

সুস্মিতা (ডানে) কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসেছেন কোচিং করতে। থাকেন ফার্মগেটের একটি হোস্টেলে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

আলোর অপেক্ষায়

এই যে শিক্ষার্থীরা হোস্টেলে থাকা–খাওয়ার, কষ্টের কথা বলছেন, ফার্মগেটের হোস্টেলগুলোর পরিবেশ আসলে কেমন, জানতে এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাঁর ঘরে গিয়েছিলাম আমরা। ধরে নিই, তাঁর নাম দীপক হালদার। সংগত কারণেই এই শিক্ষার্থীর নাম প্রকাশ করছি না। দীপকের বাবা একজন কৃষক। বাড়িতে একটা বাছুর ছিল। সেই বাছুর বিক্রি করে ছেলেকে ঢাকায় কোচিং করতে পাঠিয়েছেন। কোটি মানুষের এই শহরে দীপকের পরিচিত তেমন কেউই নেই। দূরসম্পর্কের এক চাচা আছেন। ভর্তির দিন তিনি সঙ্গে এসেছিলেন। এখন হোস্টেলে বদ্ধ কামরার বাসিন্দারাই দীপকের আপনজন।

দীপকের সঙ্গে তাঁর হোস্টেলে পা রেখেই নাকে হাত দিতে হলো। ভেতরটা অনেকটা গোলকধাঁধার মতো। গলিঘুপচির ভেতর ছোট ছোট রুম। তিনতলার করিডরটা ভূতের ছবির সেট হিসেবে মানানসই। নিবু নিবু আলো। স্যাঁতসেঁতে দেয়াল। তার মধ্যে তিনটা বিড়াল এঁটো খাবার খেতে ব্যস্ত। দীপকদের ঘরের বাসিন্দা তিনজন। তিনজন তিন এলাকার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনজন তিন ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, একজন বুয়েট, আর একজন মেডিকেলে ভর্তি হতে চান।

আমরা যখন দীপকের হোস্টেলে গিয়েছি, মেডিকেলে ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থী তখন কোচিংয়ে। অন্য দুজনের সঙ্গেই গল্প হলো। পড়া-ঘুম-কোচিং—এই হলো তাঁদের রুটিন। জনপ্রতি ৭-৮ হাজার টাকা করে দিতে হয়। এই টাকায় দুই বেলা খাবার পাওয়া যায়, এটুকুই এই শিক্ষার্থীদের বড় স্বস্তি।

‘খাবার কেমন? খেতে পারেন?’

একজন হেসে উত্তর দিলেন, ‘খেতে তো হয়ই। এখানে তো আর মা এসে খাইয়ে দিবে না।’

গুহার মতো দেখতে ঘরটার ভেতর ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে তিন শিক্ষার্থীর বইখাতা। যে স্বপ্ন পূরণের ‘যুদ্ধে’ তাঁরা নেমেছেন, সেখানে এই বইপুস্তকই তাঁদের একমাত্র সম্বল। একবার যুদ্ধে জয় পেলে এই সব কষ্ট কি ম্লান হয়ে যাবে?