মা ছাড়াই মেয়েকে যেভাবে বড় করলেন একলা বাবা

আমাদের সমাজে বিয়ে না করে বিধবা মায়েদের সন্তান বড় করতে যতটা দেখা যায়, তুলনায় বিপত্নীক বাবাদের একাকী সন্তান পালন করতে ততটা দেখা যায় কি? তবে কেউ কেউ আছেন ব্যতিক্রম। সন্তানকে নিয়ে সেই বাবাদের জার্নিটা কেমন? কোন কোন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে তাঁদের যেতে হয়, সেটা হয়তো বাবারাই ভালো বলতে পারবেন। তেমনই এক বাবা মাসুক হেলাল। স্ত্রীর মৃত্যুর পর কীভাবে সন্তানকে বড় করছেন, সেটাই অকপটে লিখেছেন এই চিত্রশিল্পী।

বাবা মাসুক হেলালের সঙ্গে মেয়ে তাসমিয়া মাসুক চর্যা
ছবি: সুমন ইউসুফ

আমার স্ত্রী যখন মারা যান, চর্যার বয়স তখন পাঁচ বছর। মায়ের অসুস্থতার জন্য বাসায় ওর পড়াশোনা হয়নি। স্কুলে ভর্তি করানো দরকার। বিভিন্ন স্কুলে ভর্তির জন্য আবেদন করা হলো। দুই-তিনটি স্কুলে পরীক্ষা দিল। ঢাকার একটি নামকরা স্কুলে টিকেও গেল। ভাইভায় মেয়েকে নিয়ে হাজির হলাম।

নাম, পেশা ইত্যাদি জানানোর পরই প্রশ্ন, ‘বাচ্চার মা কোথায়?’

বললাম, ‘মারা গেছে।’

‘এতক্ষণ বলেননি কেন? মা মরা বাচ্চা ভর্তি করানোর নিয়ম নেই।’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’

‘বাচ্চাকে রেডি করে আনতে পারবেন না।’

‘আমি তো বাবা হিসেবে আছি।’

‘বাবারা সন্তানকে সময় দিতে পারেন না।’

তিনি উঠে চলে গেলেন। সেই স্কুলে ভর্তির জন্য নানাভাবে চেষ্টা করলাম। তাঁদের বোঝাতে চাইলাম, মা না থাকলেও আমি তো আছি। বাবা হিসেবে আমি কেন মেয়েকে তৈরি করে নিয়ে আসতে পারব না! কাজ হলো না। মেয়েকে পরে মনিপুর স্কুলে ভর্তি করালাম। শুরু হলো আমার নতুন এক জীবন।

তাঁর জন্ম-মৃত্যু একই দিনে

মা–বাবার সঙ্গে ছোট্ট চর্যা, ২০০৭ সালের ছবি
ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

আমার স্ত্রী আসিয়া ২০১২ সালের ১৫ জুন মারা যান। তাঁর জন্ম এবং মৃত্যু একই দিনে। ক্যানসারে ভুগেছেন কয়েক বছর। চিকিৎসায় মাঝে কয়েক বছর সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। দ্বিতীয় দফায় অসুস্থ হয়ে আর ফিরলেন না। চর্যার নানার কবরের পাশে তাঁকে দাফন করতে বলে গেছেন চর্যার মা। সেখানেই দাফন করা হলো। পরদিন ভোরে উঠেই চর্যা তার মায়ের কবরের পাশে হাঁটে আর কাঁদে। আমি কিছুতেই বোঝ দিতে পারি না। পাঁচ দিন পর ঢাকায় ফিরব, কিন্তু চর্যা আসবে না। অনেক বুঝিয়ে মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় রওনা হই। পথে চর্যার কান্না বন্ধ হয় না।

ঢাকার বাসায় আসার পর থেকে চর্যা চুপচাপ থাকে। সারা দিন কান্নাকাটি করে। হঠাৎ চর্যার গা গরম, জ্বর কমে না। মিরপুর শিশু হাসপাতালে ডাক্তার বন্ধু সুমন চৌধুরীর কাছে নিয়ে যাই। জ্বর কমে না। সুমন পরে জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান স্যারকে দেখানোর ব্যবস্থা করল। এম আর খান চর্যাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে বললেন। সেখানে আমি মেয়েকে দুই বেলা দেখতে পারব। আমি অফিস-হাসপাতাল-বাসা করতে লাগলাম। তখন চর্যার মায়ের বান্ধবী মার্জিয়া ও তার মেয়ে অনি রাতদিন হাসপাতালে থেকেছে। তাদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

এরপর মেয়ের স্কুলে ভর্তির প্রস্তুতি শুরু হলো।

ব্যাচেলর থাকা নিষেধ

মেয়ে চর্যাকে রংতুলির ছোঁয়ায় আঁকছেন বাবা মাসুক হেলাল
ছবি: সুমন ইউসুফ

চর্যার মা মারা গেছেন মাসখানেক হয়েছে। একদিন সকালে বাসায় কাজ করছি। এক নারী এলেন আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আমি যে হাউজিংয়ে থাকি, সেখানেই তিনি থাকেন। তিনি আমার মতামত চান। আমি বললাম, ‘মাত্র তো আমার স্ত্রী মারা গেছেন, আমি সিদ্ধান্ত নিলে আপনাকে জানাব।’ ভদ্রমহিলা চলে গেলেন। কয়েক দিন পর চর্যা অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছিল। বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া নারী চর্যাকে ডেকে বললেন, ‘শোন চর্যা, তোর বাবাকে বলবি, তোর বাবা যদি বিয়ে না করে, এই হাউজিংয়ে থাকতে পারবে না। এখানে কোনো ব্যাচেলর থাকতে পারে না।’

আমি এখনো সেই কলোনিতেই আছি। সচেতনভাবে কিছু ব্যাপার এড়িয়ে চলি। আমার জন্য আমার মেয়ে যেন কষ্ট না পায়, সব সময় সেটা মাথায় রাখি। আমার ভবনের কোনো ফ্ল্যাটে গত এক দশকে যাইনি। গেলে কী হতো, সেটা পরের হিসাব, ইচ্ছা করেই যাইনি। চাইনি আমাকে নিয়ে কেউ কোনো কথা বলার সুযোগ পাক।

অফিসেও সচেতন থেকেছি। আসলে আমি আমার মেয়ে আর আঁকাআঁকির বাইরে অন্য কিছুই ভাবতে চাইনি, সময়ও পাইনি।

মাসুক বিয়ে করে ফেলবে

আমার স্ত্রী গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন। মৃত্যুর আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে চর্যাকে তোমার কাছে রাখতে। কারও কাছে দেবে না।’ সেই সঙ্গে তাঁর ব্যাংক থেকে পাওনা টাকাপয়সা আমাকে নমিনি করে দিয়ে যান। মৃত্যুর দুই মাস পর ব্যাংক থেকে আমাকে ফোন দিয়ে জানানো হয়, কিছু কাগজপত্র ও আমার মেয়ে চর্যাকে নিয়ে যেতে। যথারীতি যাই। কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর দিই। আবার কদিন পর ডাকে, বসিয়ে রাখে। কাজের কাজ কিছু হয় না। একদিন বলল, ‘ছবি নিয়ে আসবেন।’ এভাবে পাঁচ ছয় মাস চলে যায়। কয়েক দিন পর আমার স্ত্রীর এক সহকর্মী ফোনে জানান, আমার কিছু আত্মীয়স্বজন মিলে আমার বিরুদ্ধে ব্যাংকে একটি দরখাস্ত দিয়েছেন। সেখানে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘ব্যাংকের টাকা পেলে মাসুক হেলাল আবার বিয়ে করে ফেলবে।’

শুনে আমি হতভম্ব হয়ে যাই!

চর্যা আর রন্টি-ঘন্টি

মাঝেমধ্যে পুরোনো অ্যালবাম খুলে বসেন বাবা–মেয়ে
ছবি: সুমন ইউসুফ

ছোট্ট চর্যার ক্লাসে কোনো সহপাঠীর সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সে চর্যাকে বলেছে, ‘তোর মা মরেছে, খুব ভালো হইছে।’

চর্যা এরপর স্কুলে যায়নি অনেক দিন।

রাতে অফিস থেকে বাসায় ফিরতে নয়টা সাড়ে নয়টা বেজে যায়। দেখি, দরজা খোলা। চর্যা অপেক্ষা করে করে সোফায় ঘুমিয়ে গেছে। টেলিভিশন চলছে। চর্যার পুষি বিড়াল রন্টি-ঘন্টি মাটিতে ঘুমাচ্ছে। পরদিন সকালে চর্যার স্কুল। চর্যাকে ডেকে তুলে খাইয়েদাইয়ে পরের দিনের ব্যাগ-কাপড় গুছিয়ে ঘুমাতে যাই।

গভীর রাতে চর্যার কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙেছে অনেক দিন। দেখি, জানালার পাশে বসে চর্যা কাঁদছে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরি, সে বলে, ‘আম্মুর কাছে যাব।’ বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। হাউজিংয়ের মাঠে পানি জমেছে। বড় বড় আওয়াজ দিয়ে বিজলি চমকাচ্ছে। আমি চর্যাকে জড়িয়ে ধরে জানালার সামনে বসে আছি। সকাল হয়েছে। সময়মতো অফিসে যেতে পারিনি। ছবি এঁকে অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি। বিভাগীয় সম্পাদক ও গ্রাফিকস বিভাগের সহকর্মীরা ছবি ঠিকঠাকমতো বসিয়ে নিয়েছেন।

অফিসে কাজের চাপে অনেক সময় চর্যার খবর নিতে পারিনি। আমাদের ফিচার বিভাগের প্রধান সুমনা শারমীন এসে প্রায় জিজ্ঞেস করতেন, ‘মাসুক ভাই, চর্যার খবর নিয়েছেন?’ আমার পাশের বাসার ভদ্রমহিলা সব সময়ই চর্যার খোঁজখবর রাখতেন। তাঁর বাসায় ভালো কিছু রান্না হলে চর্যাকে খেতে দিয়েছেন।

সাজিয়া নামের একটা মেয়ে চর্যাকে ছোটবেলা থেকেই দেখাশোনা করত। মাঝে তার মা সাজিয়াকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। চর্যার মা মারা যাওয়াতে সাজিয়া আর যায়নি। সাজিয়া চর্যাকে সাজিয়ে-গুজিয়ে রাখত। খাওয়ানাওয়া সবটাই ও সামলাত। আমি তো সারা দিন অফিসে থাকতাম। হঠাৎ সাজিয়ার মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। সাজিয়াকে চিকিত্সার চেষ্টা করি। সে তার মায়ের কাছে বাড়ি যেতে চায়। তার পরিবারের কাছে তাকে বুঝিয়ে দিই।

এর পর থেকে স্কুল ছুটি হলে চর্যাকে বাসায় রেখে অফিসে আসতাম। অস্থায়ী গৃহপরিচারিকা দুপুর পর্যন্ত বাসায় থাকত। তারপর চর্যা রন্টি-ঘন্টিকে নিয়ে থাকত। বিকেলে পড়াতে আসতেন চর্যার শিক্ষক তামান্না। তিনি চর্যাকে এটা-ওটা রান্না করে খাওয়াতেন।

শীতের জ্যোত্স্না রাতে হাউজিং মাঠ জানালা দিয়ে দেখা যায়। সবুজ ঘাসের ওপর নানা রঙের ঘাসফুল। রন্টি-ঘন্টি ফুলের ওপর সাদা হলুদ প্রজাপতি ধরতে ছোটাছুটি করছে। চর্যাকে নিয়ে আমি মাঠে যাই। শীত, সবুজ ঘাসের ওপর সাদা রঙের রন্টি-ঘন্টি। পূর্ণিমার রাতে বাবা-মেয়ে মিলে এমন দৃশ্য আমরা উপভোগ করতাম।

চর্যা এখন অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। ভোরে উঠে নাশতা বানিয়ে নিজে খায়, আমাকে খাইয়ে তারপর কলেজের জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। আমি জানালায় বসে দেখি।

সন্তানেরা বড্ড তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়।

লেখক: জ্যেষ্ঠ চিত্রশিল্পী, প্রথম আলো