রেললাইনের পাশে বাস করা মানুষেরা যেমন ভূমিকম্প টের পান না, তেমনি অপেক্ষাগারের মানুষদের দেখেও আমার মনে হচ্ছিল, চলমান করোনা–সংক্রমণের ভয়াবহতা তাঁরা টের পাচ্ছেন না। লকডাউন থাকুক আর না থাকুক, তাঁদের যে সপ্তাহে দুই-তিন দিন হাসপাতালে আসতেই হবে।
যে কক্ষটির নাম আমি নিজে দিয়েছিলাম ‘অপেক্ষাগার’, সেটি আসলে খুলনার শেখ আবু নাসের হাসপাতালের কিডনি বিভাগের একটি কক্ষ। যেখানে সিরিয়াল না পাওয়া ডায়ালাইসিসের রোগীরা ডায়ালাইসিসের জন্য অপেক্ষা করেন। সেই কক্ষেরই একজন রোগী হিসেবে অপেক্ষা করছিলেন আমার বাবা। সঙ্গে ছিলাম আমি। আমরা রুমে ঢুকতেই উকিল নামের একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনাদের মাঝে রোগী কে?’ বাবাকে দেখিয়ে দিলে তিনি বললেন, ‘কাকাকে দেখলে তো বোঝা যায় না যে তাঁর কিডনি নষ্ট।’
সেই শুরু, এরপর শুধু ছয়জন রোগীর মধ্যে নানা আলাপ, নানা কথা। পরিচয়ের একপর্যায়ে উকিল বললেন, ‘আমার নাম আসলে দেব। একজন উকিলের গাড়ি চালাতাম। তাই মানুষ আমাকে উকিল বলেই ডাকা শুরু করল। তাই এখন কেউ নাম জিজ্ঞাসা করলে উকিলই বলি।’
তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, আপনার কত দিন ধরে ডায়ালাইসিস চলছে? বয়স তো খুব কম মনে হচ্ছে। ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার কথা কি ভাবছেন?’
পাশের সিটে বসা আরেকজন রোগী বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, কিডনি তো ওই পাশেই বসে আছে।’
তাঁর কথা শুনে পাশে বসা তাঁর স্ত্রী হেসে উঠলেন। ১৮-২০ বছর বয়সের মেয়েটার নাম পূজা। সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে স্বামীকে কিডনি দিতে যাচ্ছেন তিনি।
এরই মধ্যে রুমে প্রবেশ করলেন চিকিৎসক। সালাউদ্দীন নামের একজন রোগীকে বললেন, ‘আপনার বয়স হয়েছে। তার ওপর হৃদ্রোগী। ডায়ালাইসিসের আগে ভাবতে হবে। আমরা কোনো রিস্ক নেব না।’
সালাউদ্দীন বললেন, ‘ডাক্তার সাব! আমিও কোনো রিস্ক নেব না। বাড়ি চলে যাব। আল্লাহ যে কয়দিন বাঁচান।’
এমন সময় রুমে কাঁদতে কাঁদতে প্রবেশ করেন সালাউদ্দীনের ৮০ বছর বয়সী মা। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আরও জোরে কাঁদতে থাকেন তিনি। মা থাকার সময় নিজেকে সামলে রাখলেও তিনি চলে গেলে সালাউদ্দীনও ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।
পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে রোগীরা সবাই যে যাঁর বেডে শুয়ে পড়েন। আমি নিচে শুয়ে ছিলাম। এমন সময় বাবা ওষুধ খাবেন দেখে পূজা সবার আগে এগিয়ে আসেন। আমি উঠতে গেলে পূজা বললেন, ‘দাদা, আপনি শুয়ে থাকেন। সমস্যা নেই। আমি কাকাকে জল দিচ্ছি।’
খুব অল্প সময়ের মধ্যে সবার সঙ্গে সবার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠল। বাবা আমার ছোট খালাকে ফোনে বললেন, ‘আমি এখানে একা না। আমরা ছয়জন। রাতে যখন খাবার পাঠাবা, ছয়জনের জন্যই পাঠাবা।’
দুই দিন পর বিদায়ের সময় সবার সঙ্গে সবার আন্তরিকতা দেখে বুঝেছিলাম, রক্তের সম্পর্কের চেয়ে আত্মার সম্পর্ক কোনো অংশে কম না।
বাবা মারা গেছেন ছয় মাস হয়েছে। বাবার দীর্ঘ ১০ বছরের অসুস্থ জীবনে যাঁরা আমাদের পাশে ছিলেন, তাঁদের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। বিশেষ করে মনে পড়ে অপেক্ষাগারের সেই পূজার কথা, যার কাছে আমি ও আমার বাবা মাত্র দুই দিনেই আন্তরিকতার এক নতুন সংজ্ঞা শিখেছিলাম।