সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা আর ভাস্কর্যের মিনিয়েচার তৈরি করে বিক্রি করেন মোস্তাফিজুর

কিনব্রিজ, আলী আমজদের ঘড়ি, জৈন্তা রাজবাড়ি, শ্রীমঙ্গলের চা-কন্যা—সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা আর ভাস্কর্যের মিনিয়েচার তৈরি করেন মোস্তাফিজুর রহমান। এ কাজে তাঁর জড়িয়ে পড়ার গল্প শোনাচ্ছেন সুমনকুমার দাশ

নিজের বানানো মিনিয়েচার হাতে মোস্তাফিজুর রহমানছবি: আনিস মাহমুদ

জৈন্তাপুরের সেনগ্রামের মানুষ মোস্তাফিজুর রহমান। একসময় জৈন্তা রাজ্যের অংশ ছিল তাঁদের এলাকা। মোগল আর ইংরেজ আমলের পরও নিজেদের স্বাধীনতা ধরে রেখেছিলেন জৈন্তার রাজারা। নিজের এলাকার অতীত–সম্পর্কিত বই পড়েই স্থাপত্য ও ইতিহাসের প্রতি তৈরি হয় ভালোবাসা। শুধু তা–ই নয়, এ বই ঘেঁটেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া জৈন্তা রাজবাড়ি সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা পান। পরে রংতুলিতে একাধিকবার সেই রাজবাড়িকে এঁকেও তাঁর মন ভরেনি। নিজের এলাকার এই ঐতিহ্যকে কীভাবে আরও প্রামাণ্য করা যায়, সেই তৃষ্ণা থেকেই শুরু করেন মিনিয়েচার বানানো। ২০১৯ সালে টানা তিন দিনের পরিশ্রমে বাঁশ দিয়ে তৈরি করেন জৈন্তা রাজবাড়ির মিনিয়েচার।

মিনিয়েচার রাজবাড়ির ছবি তুলে ফেসবুকে দেন মোস্তাফিজ। বন্ধু তালিকার লোকজনের মধ্যে হইহই পড়ে যায়। একজন ফেসবুক বন্ধু বেশ দাম দিয়ে সেটা কিনেও নেন। পরিচিত আরও কয়েকজন অন্য কয়েকটা জিনিসেরও মিনিয়েচার চান। এমন সাড়ায় ব্যাপক অনুপ্রাণিত হন মোস্তাফিজুর রহমান।

এর মধ্যেই দুনিয়াজুড়ে হানা দেয় করোনা। ঘরবন্দী অলস বসে না থেকে বোতল, কলমদানি, মোটরসাইকেল, মগসহ বাঁশ দিয়ে নানা হস্তশিল্প তৈরি করে চলেন মোস্তাফিজুর। জৈন্তা রাজবাড়ির আরও মিনিয়েচার তৈরি করে বিক্রি করেন। গত বছর ‘সিলেটের প্রতীক’ খ্যাত ঐতিহ্যবাহী কিনব্রিজ ও আলী আমজদের ঘড়ির মিনিয়েচার বানান। ফেসবুকে সেসবের ছবি দিলেও দেশ-বিদেশ থেকে অনেক অর্ডার পান। একসময় মিনিয়েচার বানানোর কাজে পুরোপুরি জড়িয়ে যান মোস্তাফিজুর রহমান।

মিনিয়েচার তৈরি করছেন মোস্তাফিজুর রহমান
ছবি: আনিস মাহমুদ

ছেড়েছেন শিক্ষকতা

উচ্চমাধ্যমিক পাস করে সিলেট আর্টস কলেজ এবং শাহ আলম গ্যালারি অব ফাইন আর্ট থেকে চিত্রকলায় সার্টিফিকেট কোর্স করেছেন মোস্তাফিজুর রহমান। ২০১৫ সাল থেকে টানা পাঁচ বছর সিলেটের চারুকলি শিশুচারু বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। সিলেট আর্টস স্কুলেও শিক্ষকতা করেছেন। এরপর শিক্ষকতা ছেড়ে ক্ষুদ্রাকৃতির ভাস্কর্য তৈরিতে মনোযোগী হন ৩৬ বছর বয়সী মোস্তাফিজ।

২০১৩ সাল থেকেই সিলেট শহরের বাসিন্দা মোস্তাফিজ। তাঁর বাবা শফিকুর রহমান ও মা লায়লা বেগম অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। স্ত্রী মাহদিয়া আক্তার আর দুই সন্তান নিয়ে এখন থাকেন মেজরটিলা। তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা গেল ঘরের টেবিল আর মেঝেতে সার সার সাজিয়ে রাখা কিনব্রিজ, আলী আমজদের ঘড়ি, জৈন্তা রাজবাড়ি, শ্রীমঙ্গলের চা-কন্যা, ব্যাটনের বাড়ি। কোনোটার কাজ শেষ, অনেকগুলো নির্মাণাধীন। এসব মিনিয়েচার তৈরিতে ব্যবহার করেন কাঠ, কাপড়, বোর্ড, কাঠি, সিমেন্ট, বালু, মাটি, পাথর, কয়েন, চক, কাগজসহ নানা উপকরণ।

দাম এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দিন দিন আমাদের দেশেও মিনিয়েচারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। নিজের সংগ্রহে রাখার পাশাপাশি অনেকে অন্যকেও উপহার দিতে চান। এ সুযোগটিই বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগাতে চাই। এতে ঐতিহ্যের সঙ্গে মানুষকে যেমন পরিচিত করানো যাবে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। কয়েক মাসে আলী আমজদের ঘড়ির অন্তত ১০০ মিনিয়েচার বিক্রি করেছি। ৫টা কিনব্রিজ আর ৭টা ব্যাটনবাড়ির মিনিয়েচার বিক্রি করেছি। দিনে দুটি করে ঘড়ির মিনিয়েচার তৈরি করতে পারি, কিনব্রিজ তৈরিতে সময় লাগে দুই দিন।’

ফেসবুক পেজে মিনিয়েচারগুলোর প্রচার দেন মোস্তাফিজ। দেশ-বিদেশের অনেকে এখান থেকে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এসব স্মারক কেনেন। মিনিয়েচারগুলোর দাম এক হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা।

মোস্তাফিজুর রহমানের গড়া কিনব্রিজ, আলী আমজদের ঘড়ি
ছবি: আনিস মাহমুদ

সিলেটমগ্ন মানুষ

মোস্তাফিজুর রহমানের যেন একটাই উদ্দেশ্য, সিলেটের পরিচয়বাহী স্থাপনাকে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া। তাই সিলেটের স্থাপনা আর স্থানের বাইরে অন্য কোনো মিনিয়েচার তৈরি করেন না। এরই অংশ হিসেবে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার, হজরত শাহপরান (রহ.)-এর মাজার, মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের পুরোনো ভবন, পাঠাগার আর ছাত্রাবাস, অধুনালুপ্ত আবু সিনা ছাত্রাবাস, সারদা হলসহ সিলেট বিভাগের চার জেলার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও স্থানের মিনিয়েচার তৈরি শুরু করেছেন।

পাশাপাশি সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্যনির্ভর তথ্যচিত্রও নির্মাণ করে চলেছেন মোস্তাফিজ। এসব তথ্যচিত্রের সময়কাল এক থেকে পাঁচ মিনিট। এখন পর্যন্ত তিনটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। এর মধ্যে রিভার অ্যান্ড লাইফ: লালাখাল গত বছর ম্যাক্স স্যার ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আর এ বছর গোল্ডেন এফইএমআই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জন্য মনোনীত হয়। কিনব্রিজ নিয়ে তৈরি করা তাঁর আরেকটি তথ্যচিত্রও চলচ্চিত্র উৎসবে নির্বাচিত হয়েছে।

সামনে নিজের কাজ দিয়ে আরও সুন্দরভাবে সিলেটকে তুলে ধরতে চান মোস্তাফিজুর রহমান।

আরও পড়ুন