জার্মান সরকারের ‘ফেডারেল ক্রস অব মেরিট’ পেলেন বাংলাদেশি চিকিৎসা-পদার্থবিদ

জার্মান সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ফেডারেল ক্রস অব মেরিট’ পেয়েছেন বাংলাদেশের সন্তান ড. গোলাম আবু জাকারিয়া। জার্মানি এবং বাংলাদেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিন কাজ করার স্বীকৃতি হিসেবে সম্মাননাটি পেলেন এই চিকিৎসা-পদার্থবিদ। অধ্যাপক জাকারিয়ার জীবনের গল্প শোনাচ্ছেন নাদিম মজিদ

সম্মাননা গ্রহণ করছেন গোলাম আবু জাকারিয়াছবি: সৌজন্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়েছেন বছর চারেক, জার্মানির ভিল শহরে একরকম অবসরজীবনই এখন কাটাচ্ছেন গোলাম আবু জাকারিয়া। কয়েকটা আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত আছেন। বাকিটা সময় বাসাতেই  বইয়ের পাতায় মগ্ন থাকেন। ডিসেম্বরের সেই দুপুরেও বই পড়ছিলেন। বাড়ির দোরঘণ্টিটা হঠাৎ বেজে ওঠে। দরজা খুলে দেখেন সামনে দাঁড়িয়ে এক প্রতিবেশী। আপাত কোনো কারণ ছাড়াই ভদ্রলোক তাঁকে অভিনন্দন জানান। অভিনন্দন কেন? আবু জাকারিয়াকে ফেডারেল ক্রস অব মেরিট দিচ্ছে জার্মান সরকার। হাসিমুখে এবার সুখবরটা জানালেন সেই প্রতিবেশী।

ফেডারেল ক্রস অব মেরিট জার্মানির সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। ১৯৫১ সাল থেকে জার্মানির প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতিসহ বুদ্ধিবৃত্তিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য দেওয়া হয় এই পুরস্কার। এমন একটা খবরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না জাকারিয়া।

জার্মানির এই রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপকের হাতে তুলে দেন স্থানীয় লান্ডার্ট বা জেলা প্রশাসক এবং মেয়র। ২২ মার্চ ছিল সেই অনুষ্ঠান। সেদিন সন্ধ্যায় জার্মানির ভিল শহরে বুর্গহাউস বিয়েলস্টাইন ভবনে অধ্যাপক জাকারিয়ার হাতে সম্মাননা সনদ তুলে দেন জেলা প্রশাসক ইয়োখেন হাগট। জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ারের পক্ষ থেকে ‘ফেডারেল ক্রস অব মেরিট’ স্মারকটিও পরিয়ে দেন তিনি।

২৬ মার্চ এই প্রতিবেদকের সঙ্গে জুম বৈঠকে গোলাম আবু জাকারিয়া জানান, ‘এই সম্মাননা যে পাব, সেটা আমি কোনো দিন চিন্তাও করিনি। সম্মাননা পেয়ে ভেতরে–ভেতরে কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে। দেশে যাদের সঙ্গে কাজ করেছি, জার্মানির অনুষ্ঠানে তাদের রাখতে পারলে সবচেয়ে ভালো লাগত। তাদের সহযোগিতার কারণেই তো আমরা এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি।’

চিকিৎসা-পদার্থবিদ গোলাম আবু জাকারিয়া
ছবি: সৌজন্য

ইকরকুঁড়ি থেকে জার্মানি

৭১ বছর বয়সী গোলাম আবু জাকারিয়ার জন্ম নওগাঁর ইকরকুঁড়ি গ্রামে। পড়াশোনার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চা আর পরোপকারী মনোভাবটা পরিবার থেকেই পেয়েছেন। ১৯৬৮ সালে নওগাঁ জেলার কেডি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৭০ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে একই বছর ভর্তি হন আহছানউল্লা স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগে। দেশ স্বাধীন হলে প্রথম বছর বাংলাদেশের যে কজন শিক্ষার্থী বৃত্তি দিয়ে জার্মানি যান, তাঁদের একজন গোলাম আবু জাকারিয়া।

জার্মানিতে গিয়ে প্রথম বছর জার্মান ভাষা শেখেন লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের হারডার ইনস্টিটিউটে। দ্বিতীয় বছর ভর্তি হন মার্টিন লুথার বিশ্ববিদ্যালয়ের হালে-উটেনবার্গে। বিষয় পদার্থবিদ্যা। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় মলিকিউলার বায়োলজির জনক ম্যাক্স ডেলব্রুকের একটি বক্তৃতা জাকারিয়ার মনে গেঁথে যায়, পদার্থবিদদের উদ্দেশে এই নোবেলজয়ী সেখানে বলেছিলেন, ‘বিশ্বে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে। অনেক রক্তারক্তি হয়েছে। পদার্থবিদদের এখন উচিত, পরমাণু বোমা তৈরির কাজ বাদ দিয়ে চিকিৎসা-পদার্থ নিয়ে কাজ করা। অনেক মানুষ এতে উপকৃত হবে।’

তাঁর এ কথাই জাকারিয়ার জীবনের গতিপথ ঠিক করে দেয়। চিকিৎসা-পদার্থবিদ্যার ওপর কিছু করার ভাবনা তাঁকে পেয়ে বসে। বিষয়টি তিনি যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে তাঁর মামা ড. গোলাম মোস্তফাকে জানান। তাঁর মামাও চিকিৎসা-পদার্থবিদ। তিনিও ভাগনেকে উৎসাহ দিলেন, ‘দারুণ চিন্তা। চিকিৎসা-পদার্থবিদদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’

রোগনির্ণয় ও নিরাময় কাজে দরকারি এই চিকিৎসা–পদার্থবিদ্যা। ক্যানসারের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে এই বিদ্যা। হাসপাতালে আধুনিক যেসব যন্ত্রপাতি ও কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার করা হয়, তা চিকিৎসা–পদার্থবিদদের তত্ত্বাবধানে থাকে। মামার উৎসাহ পেয়ে ১৯৮০ সালে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা-পদার্থবিদ্যা বিভাগে পড়াশোনা শুরু করলেন ভাগনে। ১৯৮৬ সালে এ বিষয়েই পিএইচডি করলেন। সে বছরই কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৮৭ সালে কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের গুমার্চবার্গ হাসপাতালে তাঁর নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠা করা হয় মেডিকেল রেডিয়েশন ফিজিকস বিভাগ। অধ্যাপক জাকারিয়াকেই দেওয়া হয় বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব। ২০১৯ সালের আগস্টে অবসরে যাওয়ার আগপর্যন্ত এখানেই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ড. গোলাম আবু জাকারিয়া বলছিলেন, ‘ভাবতে ভালো লাগে, একজন চিকিৎসা-পদার্থবিদ হিসেবে আমি ৫০ হাজারের বেশি রোগীকে সেবা দিতে পেরেছি।’

হৃদয়ে বাংলাদেশ

জার্মানিতে যাওয়ার পর অনেকেই জাকারিয়াকে বলেছেন, আগে পড়াশোনা করে স্থায়ী হও, তারপর দেশের কথা ভেবো। আবার কেউ কেউ বলেছেন, চাকরি শেষ করে অবসর নিয়ে দেশের কথা ভাবতে পারবে। কিন্তু প্রবাসজীবনে একবারের জন্যও মাতৃভূমিকে ভোলেননি জাকারিয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বাংলাদেশের সব জাতীয় দিবস উদ্‌যাপনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৮২ সালেই হাইডেলবার্গ শহরে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বাংলাদেশ অধ্যয়ন গ্রুপ’। চাকরিজীবনেও সুযোগ পেলেই বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ, রোকেয়া, নজরুল এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর জার্মান ভাষায় বই প্রকাশ করেছেন। এসব সাহিত্যকৃতির অবদান হিসেবে ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে পেয়েছেন ‘প্রবাসী লেখক পুরস্কার’।

চিকিৎসা-পদার্থবিদ হিসেবে বাংলাদেশেও ক্যানসার চিকিৎসা নিয়ে শুরু থেকে উদ্যোগী ছিলেন। তিনি জানতেন দেশে বেশির ভাগেরই তৃতীয়-চতুর্থ পর্যায়ে ক্যানসার ধরা পড়ে। এ পর্যায়ের রোগীদের দরকার হয় রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রদানের জন্য প্রয়োজন অনকোলজি ডাক্তার, চিকিৎসা-পদার্থবিদ এবং মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। অথচ বাংলাদেশে একজনও চিকিৎসা-পদার্থবিদ ছিল না। তাই বাংলাদেশে চিকিৎসা-পদার্থবিদ্যা বিষয় চালু করার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ২০০০ সালে তাঁর আহ্বানে সাড়া দিল গণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ‘মেডিকেল ফিজিকস ও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করল তারা। শুধু তত্ত্বগত বিষয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে ব্যবহারিকভাবেও দক্ষ হওয়ার জন্য গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চুক্তির ব্যবস্থা করে দেন। ১২ বছরে প্রায় ৮০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে দেশে–বিদেশে কাজ করেন দুই শতাধিক শিক্ষার্থী।

জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ারের পক্ষ থেকে ‘ফেডারেল ক্রস অব মেরিট’ স্মারক পরিয়ে দেন জেলা প্রশাসক ইয়োখেন হাগট
ছবি: সৌজন্য

জন্মগ্রাম ইকরকুঁড়িকেও ভুলে যাননি অধ্যাপক জাকারিয়া। সেখানে প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জনকল্যাণে গড়ে তুলেছেন ‘আলোর ভুবন ট্রাস্ট’। বাংলাদেশ মেডিকেল ফিজিকস সোসাইটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত তিনি। প্রতিবছরই মাসখানেকের জন্য যখন দেশে আসেন, এসব প্রতিষ্ঠানকে সময় দেন। এই তো গত ৫ জানুয়ারি এসে মাসখানেক থেকে গেছেন।

ঢাকায় একটি বিশেষায়িত ক্যানসার হাসপাতাল এবং ক্যানসার প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন জাকারিয়া। যে হাসপাতালে সাধারণ মানুষকে কম খরচে ক্যানসার চিকিৎসা দেওয়া হবে এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে দেশে প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে তোলা যাবে। তিনি বলছিলেন, ‘ক্যানসারের চিকিৎসাকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে আসা সম্ভব। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা আমার সহকর্মীরা আমাকে সমর্থন দেবে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার মাধ্যমেই এ কাজটি করা সম্ভব। ঢাকা বা তার কাছাকাছি দেড় বিঘা জায়গা পেলে আমরা কাজটি শুরু করতে পারব। আমি মনে করি, বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ শুরু করার এখনই সঠিক সময়।’