৫ মিনিটের ব্যবধানে আনন্দ হলো বিষাদ

শুধু নারীদের নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ায় ‘ভ্রমণকন্যা—ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’। বর্তমানে ৭৭ হাজারের বেশি নারী এই গ্রুপের সদস্য। ১৮ জানুয়ারি ৫৭ জনকে নিয়ে বান্দরবানে যায় তারা। ২০ জানুয়ারি কেওক্রাডং থেকে ফেরার পথে ১৩ জন পর্যটককে নিয়ে তাদের একটি জিপ নিচে পড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান দুজন, আহত হন ১০ জন। সেদিনের দুর্ঘটনার আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন দলটির সঙ্গে থাকা সহপ্রতিষ্ঠাতা ডা. সাকিয়া হক

বান্দরবান থেকে চাঁদের গাড়িতে করে রুমায় যাওয়ার পথে মিলনছড়ি চেকপোস্টে, পেছনে পাহাড় আর সাঙ্গু নদী। ছবিটি দুর্ঘটনার আগের দিন তোলাছবি: সংগৃহীত

২০ জানুয়ারির সকালটা ছিল রোদে ঝলমল। সবাইকে কেওক্রাডংয়ের মাইলফলকের সামনে দাঁড় করালাম। ছবি তোলা হলো। এখন রিলের যুগ, অনেকে ভিডিও বানাতে চান। ফিরোজা আন্টি বললেন, ‘তোমরা জাতীয় সংগীত গাও।’ সবাই মিলে গাইলাম, ‘আমার সোনার বাংলা।’ বেশ খানিকটা সময় সেখানেই কাটল। ভ্রমণে আসা প্রত্যেক নারীই এই উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে উচ্ছ্বসিত।

কেওক্রাডংয়ে যাঁরা দুই রাত থাকবেন, যেমন আমার মা (শাশুড়ি), শিলুদি প্রমুখ, তাঁদের ওখানেই রেখে বাকি ৩৭ জনকে নিচে জিপের কাছে নামালাম আমরা। এই দলই আজ রাতে ঢাকায় ফিরে যাবে।

৫৭ জনের একটি দল নিয়ে আমাদের এবারের সফর। ‘ভ্রমণকন্যা’র এটি ২২৬তম ট্রিপ। বড় দল। তার মধ্যে একাংশ থাকবে দুই দিন, আরেকাংশ তিন দিন। দুই দিনের দলের নেতৃত্বে নুসরাত জাহান (রিজভী নামে পরিচিত বেশি) ও জয়নব খাতুন। বাকি ২০ জনের দলটির দায়িত্বে রইলাম আমি আর সিলভী রহমান।

বান্দরবানের পাহাড়ে রিজভীর সেলফিতে সিলভী, সাকিয়া ও জয়নব (বাঁয়ে)
ছবি: সংগৃহীত

এবারের ট্রিপে ছিলেন নানা বয়সের নারী। শিশু থেকে ৬০ বছরের প্রবীণ। ১৯ জানুয়ারি ভোরে আমরা যখন বান্দরবানে পৌঁছাই, তাঁদের মুখে তখন রাজ্যের মুগ্ধতা। প্রিয়জনকে ফোন করে মেঘ-পাহাড়ের বর্ণনা দিচ্ছেন, তাঁদের কণ্ঠে ঝরে পড়ছে উচ্ছ্বাস। বরাবরের মতোই আমাদের এবারের ট্রিপেও কয়েকজন মা ছিলেন। ভ্রমণকণ্যার কমিটি মেম্বার রিজভীর মা ফিরোজা খাতুনও গিয়েছিলেন মেয়ের সঙ্গে। ফিরোজা আন্টি যাবেন শুনে কমিটির আরেক সদস্য শান্তার আম্মাও (আছিয়া বেগম) যোগ দিলেন, গেলেন আমার শাশুড়িও।

দুর্ঘটনার আগের দিন

৫টা চাঁদের গাড়িতে (জিপ) ৫৭ জন। আনন্দ করতে করতে সার ধরে যাচ্ছে আমাদের গাড়িগুলো। কিছুক্ষণ বসে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পাহাড়, মেঘ আর এদিক–সেদিক থেকে বের হওয়া সাঙ্গু নদী দেখতে দেখতেই রুমায় চলে এলাম। এখান থেকে যাব বগালেকে। লেকে যাওয়ার পাহাড়ে আগে কত কষ্ট করে হাঁপাতে হাঁপাতে লাঠি নিয়ে উঠতাম, একটু এদিক–সেদিক হলেই একদম খাদ। সেই পথ এখন কত সহজ, গাড়িতে করে আসা যায়। বগালেকে সেনাবাহিনীর কটেজ আর রবার্টদার (স্থানীয় হোমস্টে উদ্যোক্তা) ঘর মিলিয়ে আমাদের ৫৭ জনের থাকার ব্যবস্থা হলো।

বাকিদের খেতে বলে আমরা চার টিমলিডারসহ ১০-১২ জন চলে গেলাম বগালেকে। একটু পর দেখি মগ নিয়ে মায়েরাও চলে এসেছেন, তাঁরাও গোসল করবেন। হাসি-ঠাট্টা; রিজভীর মা আর শান্তার মা, দুই আন্টির মিষ্টি খুনসুটি। দারুণ একটা সময় কাটল।

কেওক্রাডং হেলিপ্যাডে সাকিয়া হক, সিলভী রহমান, নুসরাত জাহান ও জয়নব খাতুন (সর্বডানে)। ছবিটি তোলার কিছুক্ষণ পরই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মারা যান জয়নব
ছবি: সংগৃহীত

সন্ধ্যা হলো। গানের আসর জমে উঠল, চলল গভীর রাত পর্যন্ত। মাঝখানে আমরা ক্যাম্পফায়ার আর বারবিকিউ করে ফেললাম। রাত তখন একটা। তখনো চাঁদের আলোয় আবিষ্ট আমরা পাঁচ-ছয়জন। হাঁটছি আর গল্প করছি। জয়নবের প্রশ্ন, ‘আপু, এত দূরে মানুষজন একটা লেক দেখতে আসে!’ আমি ওকে ১০-১৫ মিনিট শুধু বগালেকের ইতিহাস বলেই কাটিয়ে দিলাম। সিলভী আর জয়নব মিলে নিজেদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা গল্প করতে করতে কাটাল আরও অনেকটা সময়।

রাতে যখন ঘুমাই, আমার এক পাশে জয়নব, আরেক পাশে সিলভী। সকালে আমাদের ঘুম থেকে তোলার দায়িত্ব জয়নবের। সকালে উঠেই কেওক্রাডংয়ে যাব বলে শাড়ি পরলাম। সবাইকে নিয়ে গাড়িতে করে রওনা দিলাম। আগেও অনেকবার ভ্রমণকন্যারা কেওক্রাডংয়ে এসেছেন। তবে এবার ৫৭ জনের দল। রাস্তা সব জায়গায় পিচঢালা নয়, তবে কেওক্রাডংয়ের কাছাকাছি এসে রাস্তাটা বেশ ভালো হয়েছে। নিচ পর্যন্ত কাজ চলছে বোঝা যায়। আর্মি ক্যাম্পে চেকইন করেই অনেকে দৌড়ালেন হেলিপ্যাডে। সবাই লাফ দিলেন আর আমি এসবের ছবি তুললাম।

ফেরার পথে

কেওক্রাডংয়ে দারুণ সময় কাটিয়ে জয়নব-নুসরাতদের তিনটি চাঁদের গাড়িকে বিদায় জানালাম। প্রথম দুটি গাড়িতে ২৪ জনকে বসানোর পর শেষ জিপে নুসরাত (রিজভী), ওর মা ফিরোজা আন্টি, শান্তার মা, জয়নবসহ ১৩ জন। চালকের পাশের সিটে ফিরোজা আন্টি আর জিপের শেষ দিকে জয়নব। একটার পর একটা জিপ স্টার্ট নিচ্ছে আর আমি ভিডিও করছি।

পাহাড়ি খাদে পড়ে যাওয়া জিপ গাড়ি
ছবি: সংগৃহীত

গাড়িগুলো চলে যাওয়ার ৫ মিনিটের মধ্যে একটি গাড়ি ফিরে এল। গাড়ির ভেতর থেকে এক ট্রাভেলার রনি আপুর চিৎকার, ‘আপু, রিজভীর জিপ খাদে পড়ে গেছে।’ প্রথমবারে কথাটা বুঝিনি, আরেকবার বলার পরই সঙ্গে থাকা সিলভীকে চিৎকার করে ডেকে আরেকটা জিপে উঠে গেলাম। সঙ্গে স্থানীয় কয়েকজন। একটু এগোতেই দেখি, রাস্তায় জটলা আর আমাদের বাকি মেয়েরা দাঁড়ানো।

ওদের আঙুলের ইশারায় রাস্তা থেকে নিচে তাকিয়ে হৃৎপিণ্ডটা কেঁপে উঠল। আমাদের সাদা জিপটা। প্রায় পাঁচ-ছয়তলা সমান নিচে পড়েছে গাড়িটা। মুহূর্তে জিপে ওঠা সবার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল। ঝটপট নিচে নেমে গেলেন স্থানীয় ১০-১২ জন। আমার হাত-পা কাঁপছে। বসে পড়লাম। এই অঞ্চলে সচরাচর নেটওয়ার্ক না থাকলেও ঠিক ওই জায়গায় অদ্ভুতভাবে নেট ছিল। পূর্বপরিচিত এডিসি সাইফুল স্যারের নম্বরে ডায়াল করলাম। স্যার বললেন, ‘এক্ষুনি রুমায় সব ব্যবস্থা করছি, আপনারা ওনাদের নিয়ে আসেন।’

 রুদ্ধশ্বাস কয়েক ঘণ্টা

এর মধ্যেই একজন উঠে এসেছেন, তাঁর কাঁধে জয়নব। চোখ বন্ধ, ঠোঁটটা হালকা বেগুনি। চুল লতা-পাতায় ভরা। ওকে আমার কোলে রাখলেন। অবচেতন মনেই নাড়ি দেখলাম। পালস নেই। আমি তারপরও বললাম, ‘জয়নব, বাবু, তাকা। একবার চোখটা খুলে দেখ।’

কত ডাকলাম, সিপিআর দিলাম, মাউথ টু মাউথ দিলাম। জয়নব নেই, ওপরে ওঠানোর আগেই ও নেই। বললাম, ‘ওকে ছেড়ে আমি যাব না।’ আমার কাঁধে হাত রাখলেন সম্ভবত শাহরিন আপু। বললেন, ‘আপু, তুমি শক্ত হও। ভুলে যেয়ো না, তুমি চিকিৎসক। সবার জন্য তোমাকে শক্ত হতে হবে।’

আমি আবার ফোন হাতে নিলাম। কল দিলাম ভ্রমণকন্যার শুভাকাঙ্ক্ষী (সমাজকল্যাণমন্ত্রী) দীপু মনি আপাকে আর ভ্রমণকন্যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মানসী সাহাকে।

দুর্ঘটনাস্থলে এই জায়গা দিয়ে গাড়িটি নিচে চলে যায়
ছবি সংগৃহীত

এক এক করে ক্ষতবিক্ষত মানুষগুলোকে ওপরে তোলা হচ্ছে। সবাই রক্তে মাখামাখি। চারদিকে শুধু চিৎকার আর আহাজারি। কেউ কোমর নাড়াতে পারছেন না, কেউ হাত-পা। কারওরও নিশ্বাস ঠিকভাবে পড়ছে না।

রিজভী উঠল। কপাল থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে। দেখলাম, কপালে এত্ত বড় একটা ক্ষত, হাড় ভেদ করে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে।

ও উঠেই বলল, ‘আপু, মা আর নাই।’ নেই মানে? একটু আগে যিনি সবাইকে দাঁড় করিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে বললেন, সেই মানুষ নেই! আগের দিনই যিনি সবার জন্য বরই কিনে পোটলা বাঁধলেন, সেই ফিরোজা আন্টি আর নেই! আন্টিকে ওপরে তোলা হলো। ওঠানো হলো শান্তার আম্মুকে। নিশ্বাস ফেলছেন খুবই ধীরগতিতে। পাঁজরের হাড়গুলো ভেঙে গেছে, ভেঙেছে পা-ও।

আমাদের গ্রুপে তিন-চারজন চিকিৎসক ছিলেন। সবাই হাত লাগালেন। দ্রুত ভাগে ভাগে সবাইকে জিপে উঠিয়ে রুমার পথে রওনা দিলাম। সিলভীকে বললাম, বাকি ৪৫ জনকে কেওক্রাডং থেকে রুমায় নিয়ে আসতে।

উদ্ধারের পর আহতদের আনা হচ্ছে হাসপাতালে
ছবি: সংগৃহীত

জিপে ব্যথায় সবাই কাতরাচ্ছেন। আমার মুঠোফোনে শত শত ফোন। সিভিল সার্জন ফোন করে বললেন, ‘চিন্তা কোরো না। বান্দরবান রেডি। অ্যাম্বুলেন্স, অর্থোপেডিক সার্জন, অ্যানেসথেটিওলজিস্ট সব রেডি।’ এদিকে দীপু মনি আপার সঙ্গে আলোচনা করে ঢাকা থেকে মানসী বলল, ‘যত দ্রুত সম্ভব চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাও। আপা ওদিকে ব জায়গায় বলে রেখেছেন।’

রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থামলাম। এখান থেকে বান্দরবান সদর আড়াই ঘণ্টা। তাই আগে প্রাইমারি ম্যানেজমেন্ট করতে হবে। সেখানে মাত্র একজন মেডিকেল অফিসার, তিনি তাঁর সর্বোচ্চটা দিলেন। নার্স, ওয়ার্ড বয় তো আছেনই, সঙ্গে আমরা যে কজন চিকিৎসক ছিলাম, তারাও কাজ শুরু করলাম। কারও ব্যান্ডেজ লাগবে, কারও অক্সিজেন লেভেল মাপতে হবে। ওই গাড়ির একজনই শুধু অক্ষত ছিলেন। একই সঙ্গে প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, সবার সঙ্গে সমন্বয় করতে হচ্ছে। হাজার হাজার প্রশ্ন। জয়নব আর ফিরোজা আন্টিকেও বেডে আনলাম আমরা। বারবারই ইসিজি চেক করছি। জানি, তাঁরা আর চোখ খুলবেন না। তাও বারবারই দেখছি। কোনো সাড়া নেই।

সবচেয়ে খারাপ অবস্থার তিনজনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সে আগে বান্দরবান সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম। ১০ মিনিটের মধ্যে আরেকটা অ্যাম্বুলেন্স এল। ওটাতে আরও তিনজন। বিজিবিও তাদের একটা অ্যাম্বুলেন্স আনার ব্যবস্থা করে দিল। প্রান্তিক একটা উপজেলায় তিনটা অ্যাম্বুলেন্স আসতেও সময় লাগছিল। এদিকে আহত মেয়েরা ছটফট করছেন। সবাইকে কোনোরকমে তিন ঘণ্টা বেঁচে থাকার মতো অবস্থা করে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিলাম। প্রতিটি অ্যাম্বুলেন্সেই আমাদের ট্যুরের চিকিৎসক ভ্রমণকন্যাদের সঙ্গে পাঠালাম।

অপেক্ষা স্বজনদের

জয়নবের পরিবার আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফোন আসছে। মাগুরা থেকে রিজভীর বাবার ফোন, চেনা-অচেনা ফোনের পরে ফোন। সবাইকে শুধু বললাম, বড় দুর্ঘটনা, আপনারা রওনা দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছিলেন জয়নব খাতুন
ছবি: সংগৃহীত

শান্তাকে বললাম, ‘যেভাবে হোক, যত তাড়াতাড়ি হোক, চট্টগ্রামে আয়, আন্টির অবস্থা ভালো না।’ শান্তা তখনই রওনা দিল।

পুলিশ ময়নাতদন্ত ছাড়া ফিরোজা আন্টি ও জয়নবকে ছাড়বে না। ততক্ষণে জয়নবের ভাইকে এই হৃদয়বিদারক কথা আমাকে বলতেই হয়েছে। তাঁরাও ময়নাতদন্ত চান না। রিজভী তাঁর মায়ের দায়িত্ব নিল আর আমি জয়নবের। আমার ছোট বোন জয়নব। কতবার ওকে বাসায় ডেকেছি, ‘আয় খাওয়াব।’ আসার পর বলতাম, ‘না, রান্নাটা তুই-ই কর।’ কত স্মৃতি!

জয়নব ও ফিরোজা আন্টির লাশসহ রিজভী আর সিলভীকে নিয়ে বাকি ৪৫ জনসহ আমরা রওনা দিলাম বান্দরবানের দিকে।

আমি গাড়ির পেছনে, সঙ্গে ফোমের ওপর শায়িত জয়নব আর ফিরোজা আন্টি। প্রচণ্ড বাতাস ও শীতে একটা কানে কিছুই শুনছি না। বান্দরবানের পাহাড়ি রাস্তা ধরে ছুটছে আমাদের গাড়ি। চারদিকের সবুজ পাহাড় আর তুলার মতো মেঘ তখন অসহ্য লাগছে। চিন্তা শুধু কতক্ষণে সদর হাসপাতালে পৌঁছাব!

ফিরোজা খাতুনের এই ছবিটি ২০২২ সালে বান্দরবানেই তোলা। এবারও কানে জবাফুল দিয়ে এমন একটি ছবি তুলেছিলেন, ফোনটি হারিয়ে গেছে। দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তিনি
ছবি: সংগৃহীত

জেলা পরিবহন শ্রমিক সমিতির সহায়তায় এর মধ্যে লাশবাহী ফ্রিজার গাড়ি চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানে আনার ব্যবস্থা করলাম। বারবার ফোন করছিলাম। একেকটা অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছাচ্ছে আর বান্দরবান সদর হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সবই জানতে পারছিলাম। বেশি সংকটাপন্ন বলে শান্তার আম্মুকে সদর হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।

চট্টগ্রামে পৌঁছাল শান্তা, আছমা, সোমা, মানসী, টুম্পা ও রিজভীর স্বামী সজীব (মিয়া) ভাই। আমি বান্দরবান সদর হাসপাতালে পৌঁছে দেখি এমপি মহোদয়, জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন, এসপিসহ অনেকেই উপস্থিত। থমথমে পরিবেশ।

আরও দুজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হলো। লাশবাহী ফ্রিজার গাড়িতে জয়নবকে ওঠানো হলো। জয়নবের সঙ্গে নীরবে উঠে গেল সিলভী। আরেকটা ফ্রিজার ভ্যানে দুজন ভ্রমণকন্যাসহ ফিরোজা আন্টি। আহত রিজভীসহ তিনজনকে আরেকটা অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিলাম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে।

প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে যাবে জয়নব। আর ফিরোজা আন্টিকে নেওয়া হবে মাগুরায়।

ফোনে মানসীর সঙ্গে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিলাম। ওর দায়িত্বে চট্টগ্রামের ছয়জন। আর বান্দরবানে চিকিৎসা নিতে থাকা চারজনকে আমি দেখব। চট্টগ্রামের চিকিৎসকেরাও ততক্ষণে প্রস্তুত। রোগী এলেই এক মিনিট দেরি না করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সরাসরি চিকিৎসকের কাছে। শান্তার আম্মুকে ওটিতে নেওয়া হলো, তাসনিম নামের আরেক আপুর হিপ ডিসলোকেশন হয়েছে। বাকিরা পৌঁছানোর পর তাঁদেরও একইভাবে চিকিৎসা শুরু হলো। পরিবারের দায়িত্বে দুজন চট্টগ্রাম থেকে তখনই চলে গেলেন। রিজভীকে দেখে দ্রুত সিটি স্ক্যানের পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক। তাঁকে নিয়ে পাশের একটি হাসপাতালে ছুটলেন সজীব ভাই। জয়নব আর ফিরোজা আন্টির নিথর দেহ গোসলের জন্য হাসপাতালের মসজিদের পাশে নেওয়া হলো। গোসলের পর নতুন কাপড় পরানো হলো। রৌমারী থেকে জয়নবের ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অপেক্ষা করছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেলে পৌঁছেছেন ফিরোজা আন্টির স্বামী, রিজভীর বাবা। লাশ ধোয়ানোর ঘরের সামনে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো। ফ্রিজার ভ্যান ধরে আঙ্কেলের তখন একটাই কথা, ‘বড় স্বপ্ন নিয়ে নতুন বাড়ি করেছি। ভ্রমণ থেকে ফিরেই সেই বাড়িতে উঠবে বলেছিল ফিরোজা। এখন আমি কাকে নিয়ে তুলব সেই বাড়িতে!’

তাঁর এই প্রশ্নের উত্তর তখন আমাদের কারও কাছে নেই।

সর্বশেষ: দুর্ঘটনার পর থেকেই পলাতক গাড়ির চালক। ভ্রমণকন্যার পক্ষে বাদী হয়ে মামলা করেছে পুলিশ। আহত ১০ জনের মধ্যে ৪ জন বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নিহত ও আহত মেয়েদের মঙ্গল কামনা করে ২৩ জানুয়ারি ঢাকার বিয়াম মিলনায়তনে এবং ২৬ জানুয়ারি জয়নবের গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামের রৌমারীতে ভ্রমণকন্যাদের উপস্থিতিতে দোয়ার আয়োজন করা হয়। দুর্ঘটনার পর সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের পরিচিত-অপরিচিত মানুষেরা খোঁজখবর নিচ্ছেন, সাহায্য করছেন, সবার প্রতি ভ্রমণকন্যারা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।