‘আপাতে আপাতে’ গায়িকা রোজে যেভাবে কে–পপের দুনিয়ায় পা রেখেছিলেন

ফেসবুক, ইউটিউব অথবা টিকটক নিয়মিত ব্যবহার করেন, অথচ ‘আপাতে আপাতে’ গানটি একবারও কানে আসেনি, এটা প্রায় অসম্ভব। গত অক্টোবরে মুক্তি পাওয়ার পর দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছে ব্রুনো মার্স ও রোজের এই গান। কে-পপ ব্যান্ড ব্ল্যাকপিংকের অন্যতম সদস্য রোজে অবশ্য ‘আপাতে আপাতে’ বেরোনোর আগে থেকেই তুমুল জনপ্রিয়। নিউজিল্যান্ডে জন্ম, অস্ট্রেলিয়ায় বড় হওয়া। তবে রোজে শিল্পী হয়ে উঠেছেন মূলত দক্ষিণ কোরিয়ায়। কীভাবে? সে কথাই বলেছেন নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক পডকাস্টে।

কে-পপ ব্যান্ড ব্ল্যাকপিংকের অন্যতম সদস্য রোজে ‘আপাতে আপাতে’ বেরোনোর আগে থেকেই তুমুল জনপ্রিয়ছবি: এএফপি

মানুষ আমাকে রোজে ডাকে, রোজিও ডাকে। আমি সাধারণত রোজে বলে পরিচয় দিতেই পছন্দ করি। ব্ল‍্যাক পিংকের রোজে হয়ে উঠতে আমাকে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু রোজি সেই মানুষটা, যাঁকে আমার বন্ধু-পরিবার চেনে। রোজে গানের পাগল, নাচে পারদর্শী। আর রোজি একটা ঘরকুনো মেয়ে, বিছানায় গড়াগড়ি খেতে যে ভালোবাসে।

নিজের নামে অ‍্যালবাম করাটা একটা স্বপ্ন ছিল। নানা গায়িকার গান শুনে বড় হয়েছি। তাঁদের গানের কথাগুলোর সঙ্গে কেন যেন নিজের জীবনেরও মিল খুঁজে পেতাম। অনেক কঠিন সময় পার করতে এসব গান আমাকে সাহায্য করেছে। একদিন আমার গানও মানুষের মনে নাড়া দেবে, এমন স্বপ্ন দেখতাম ঠিক। কিন্তু স্বপ্নটা যে বাস্তব হতে পারে, সত‍্যিই ভাবিনি।

কে-পপের দুনিয়া

আমার আত্মবিশ্বাস ছিল খুব কম। মা-বাবা দক্ষিণ কোরিয়ান কিন্তু জন্ম নিউজিল‍্যান্ডে। আট বছর বয়সে চলে যাই অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়ার শহর তো আসলে সিউল বা নিউইয়র্কের মতো নয়, ওখানে আমার তেমন কিছু করার ছিল না। স্কুল-বাসা-স্কুল-বাসা, এই ছিল রুটিন। একঘেয়েমি কাটাতে মা-বাবা ভর্তি করিয়ে দেন পিয়ানো ক্লাসে। পিয়ানো বাজাতাম, খাতায় নোট লিখে রাখতাম। একসময় ইউটিউবে দেখলাম, অনেকেই গিটার হাতে নানা গান কাভার করছে। মনে হলো বাহ, এটা তো দারুণ। আমিও গিটার হাতে নিলাম। বাজাতে শুরু করলাম। হ‍্যাঁ, পুরো ব্যাপারটাই খুব সাবলীলভাবে হয়েছে। গানই হয়ে উঠেছিল আমার বিনোদন।

ইউটিউবে কে-পপ লিখে সার্চ করলে তখন এক নতুন দুনিয়া চোখের সামনে হাজির হতো। সেই দুনিয়াতেই দেখলাম, অনেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, কে-পপ তারকা হয়ে উঠছে। এসব দেখে মাঝেমধ্যে ওই তারকাদের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতাম। আবার নিজেই ভাবতাম, ‘যাহ, এটা কি কখনো সম্ভব!’

রোজে
ছবি: এএফপি

বড় সুযোগ

একদিন বাবা জানাল, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে অডিশনের জন‍্য অস্ট্রেলিয়া আসছে ওয়াইজি (কোরিয়ান নাচ-গান শেখার একডেমি)। সেই সময় সাধারণত ওরা অন‍্য দেশে গিয়ে অডিশন নিত না। বাবা বলল, ‘রোজি, তুমি তো রোজই মাঝরাত পর্যন্ত গান গাও। রীতিমতো টেনে তোমাকে বিছানায় নিতে হয়। গান গাইতে ভালো যখন বাসোই, অডিশন দিতে আপত্তি কোথায়?’

বললাম, ‘পাগল! আমি তো ভালোমতো জানিও না, গান কীভাবে গাইতে হয়।’ ভাবছিলাম বাবা মজা করছে। কিন্তু বাবাই আমাকে বোঝাল, ‘সুযোগ যদি না-ও পাও, এটা একটা ভালো অভিজ্ঞতা হবে। ২৬ বছর বয়সে গিয়ে আফসোস কোরো না যে কেন কোনো দিন চেষ্টাও করলাম না।’

তারপর? অডিশনের জন‍্য আমরা সিডনি গেলাম। বাকি সবার পরিবেশনা দেখে মনে হচ্ছিল, ওরা কী দারুণ গায়! মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলাম, ‘ধন‍্যবাদ। খুব মজা হলো। এবার আসি,’ বলে বিদায় নেব। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওরা ডেকে পাঠাল। আর বলল, ‘ব‍্যাগ গোছাও। দুই মাসের মধ‍্যে তোমাকে কোরিয়া যেতে হবে।’

ধাক্কা

মা শুরুতে একদমই রাজি ছিল না। স্বাভাবিক। তার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। কিন্তু বাবা খুব চাইছিল। আর আমার কথা যদি বলি, তখনো আসলে অত ভাবাভাবির মতো বয়সই হয়নি। রোমাঞ্চটাই বেশি কাজ করছিল। মা-বাবাকে ছেড়ে যাব, এটা মাথাতেই আসেনি। মাথায় শুধু ঘুরছিল, ‘ইয়েএএ! আরও অনেক মেয়েদের সঙ্গে ডর্মে থাকব!’

যখন স্কুলে পৌঁছালাম, আমাকে ডর্মে দিয়ে মা-বাবা বলল, ‘ঠিক আছে। আমরা তাহলে যাই।’ তখন প্রথম ধাক্কাটা খেলাম। ‘যাই মানে? তোমরা কোথায় যাবে?’

মা বলল, ‘আমাদের তো যেতেই হবে।’ প্রথমবারের মতো ভয়টা পেয়ে বসল তখনই।

আরও পড়ুন

ইউটিউবের ভিডিওতে তো তখন পর্যন্ত শুধু কোরিয়ান সংস্কৃতির ঝলমলে, তারকাসমৃদ্ধ রূপটাই দেখেছি। এর পেছনের শ্রম আর একাকিত্বের অংশটা দেখিনি। তাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস, শেষ পর্যন্ত সামাল দিতে পেরেছি।

ওয়াইজির দিনগুলো

খুব সকালে আমাদের উঠতে হতো। আমি অবশ্য উঠতাম সাড়ে ৯টার দিকে। নাশতা করে চলে যেতাম নাচের ক্লাসে। নাচ, ভাষা, গান, সবকিছুর চর্চাই হতো। দুইটার দিকে অনুশীলন শেষ হতো।

আমি সত‍্যিই প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছি; কারণ, অনেক দূর থেকে আমি এসেছিলাম। ব্যর্থ হতাম, তাহলে আবার আমাকে অস্ট্রেলিয়া ফিরতে হতো। জেদ, শৃঙ্খলা যে আমার মধ‍্যে আগে থেকেই ছিল, তা নয়। ওখানকার পরিবেশটাই এমন, এগুলো আমার মধ‍্যে তৈরি হয়ে গেছে।

দুই সপ্তাহের মধ‍্যে আমরা মাত্র এক দিন ছুটি পেতাম। ব্ল‍্যাকপিংকের আরেক সদস‍্য লিসাও সেই স্কুলে ছিল। আমরা এক রুমে থাকতাম। ও এসেছিল থাইল্যান্ড থেকে। ওরও যেহেতু সিউলে কোনো আত্মীয়স্বজন ছিল না, ছুটির দিনে দুজন একসঙ্গে ঘোরাঘুরি করতাম। চার্চে যেতাম, শপিংয়ে যেতাম। ঘুরে ঘুরে জর্ডানের দামি দামি স্নিকার্স দেখতাম আর ভাবতাম, ‘কী সুন্দর!’ কিন্তু আমাদের তো কেনার মতো টাকা ছিল না। ‘পরে কোনো একদিন কিনব,’ এই বলে মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম।

পোশাক–আশাকটাও কিন্তু আমাদের প্রশিক্ষণের অংশ ছিল। সাপ্তাহিক, মাসিক পরীক্ষায় ফ‍্যাশনাটাও বিবেচনা করা হতো। বাসা থেকে যেটুকু টাকা পাঠানো হতো, তা দিয়েই কেনাকাটা করে ফিটফাট হয়ে আমরা নিজেদের প্রমাণ করার চেষ্টা করতাম।

ওয়াইজি এন্টারটেইনমেন্টে আমাদের সবই শেখানো হয়েছে। কিন্তু খ‍্যাতি কীভাবে সামাল দিতে হয়, সেটা শিখেছি নিজে। হয়তো মানসিকভাবে আমাদের সক্ষম মনে হয়েছিল বলেই ওরা আমাদের বেছে নিয়েছিল।

একাডেমিতে প্রায় চার বছর ছিলাম। সকাল-বিকেল-রাত—দিনের সবটা সময় গানের জন‍্য ঢেলে দেওয়া সেই দিনগুলো খুব মিস করি। এখন যখন প্রশিক্ষণার্থীদের দিকে তাকাই, খুব হিংসা হয়।