আপনার সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে এই ব্রাউজার
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমরা অনেকে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা তুলে গুগলে কিছু একটা সার্চ করি। এরপর অফিসে গিয়ে ল্যাপটপ খুলে সারা দিন ইন্টারনেট সার্ফিং। আমাদের কাজের জগৎ হোক বা বিনোদন—সবকিছুর চাবিকাঠি হলো ওই ছোট্ট সফটওয়্যারটি, যাকে আমরা বলি ওয়েব ব্রাউজার। হয়তো ভাবছেন, ব্রাউজার দিয়ে তো শুধু ইন্টারনেট চালাই, এর আবার ভালো-মন্দ কী? এখানেই আমরা ভুলটা করি। সব ব্রাউজার কিন্তু এক নয়। কিছু ব্রাউজার আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু, আর কিছু ব্রাউজার আপনার ঘরের ভেতরের গুপ্তচর! হয়তো বিশ্বাস করে আপনার পাসওয়ার্ড, লোকেশন, পছন্দের জিনিসের তালিকা তুলে দিচ্ছেন সেই ব্রাউজারের হাতে। আর সেটি আপনার তথ্য পুঁজি করে সুবিধা করে দিচ্ছে বিজ্ঞাপনদাতাদের। আজ আমরা সেই খলনায়করূপী ব্রাউজারটির মুখোশ খুলব এবং জানব বাঁচার উপায়।
গোপনীয়তার জন্য সবচেয়ে বাজে ব্রাউজার কোনটি
উত্তরটা শুনে হয়তো আপনি আকাশ থেকে পড়বেন। কারণ, সম্ভবত আপনি এই মুহূর্তে সেই ব্রাউজারটি দিয়েই এই লেখা পড়ছেন। হ্যাঁ, পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্রাউজার—গুগল ক্রোম। এটিই আপনার প্রাইভেসি বা গোপনীয়তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।
মার্কিন সাইবার গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির সাবেক চিফ টেকনোলজি অফিসার বব গার্লি দিয়েছেন চমকপ্রদ সব তথ্য। সোজাসাপটা বলে দিয়েছেন, ‘ক্রোমের জন্মই হয়েছে আপনার ওপর নজরদারি করার জন্য। এটা এমন এক কোম্পানির বানানো, যাদের পুরো ব্যবসাই চলে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে বিজ্ঞাপন দেখানোর ওপর।’
ভাবুন তো, পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ ক্রোম ব্যবহার করে। আর গুগল এই ১০০ কোটি মানুষের প্রতিটি ক্লিকের হিসাব রাখে। আপনি কী সার্চ করছেন, কোন লিংকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকছেন, মাউসটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন—সব তারা জানে। বব গার্লির মতে, ‘এটা আসলে ব্রাউজারের ছদ্মবেশে এক বিশাল নজরদারির যন্ত্র।’
ইনকগনিটো মোড কি নিরাপদ
অনেকে ভাবেন, আমি তো ইনকগনিটো বা প্রাইভেট মোড ব্যবহার করি, আমাকে গুগল ধরবে কীভাবে? দুঃখিত, এটা নিতান্তই ভুল ধারণা। ইনকগনিটো মোড শুধু আপনার ডিভাইসে বা কম্পিউটারে হিস্ট্রি জমা হওয়া ঠেকায়।
কিন্তু গুগল ঠিকই জানে, আপনি কোথায় যাচ্ছেন। আপনার আইপি অ্যাড্রেস, লোকেশনসহ সবই তাদের সার্ভারে জমা হচ্ছে। আপনি যদি ইনকগনিটো মোডে নিজের গুগল অ্যাকাউন্টে লগইন করেন, তবে তো কথাই নেই! আপনার সব গোপন তথ্য গুগলের হাতের মুঠোয়।
ক্রোম আপনার সম্পর্কে কী কী জানে
ক্রোম আপনার সম্পর্কে এত তথ্য জানে, যা হয়তো আপনার কাছের বন্ধুরাও জানে না। একনজরে দেখে নিই সেই তালিকা—
১. ব্রাউজিং হিস্ট্রি: আপনি কবে, কখন, কোন সাইটে গেছেন।
২. সার্চ কুয়েরি: আপনি গুগলে কী কী লিখে সার্চ করেছেন।
৩. বুকমার্ক: আপনার পছন্দের ওয়েবসাইটগুলো কী কী।
৪. লোকেশন: আপনি এখন কোথায় আছেন (আইপি অ্যাড্রেসের সাহায্যে)।
৫. পাসওয়ার্ড: সেভ করা ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড।
৬. অটোফিল তথ্য: আপনার নাম, বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর।
৭. ডিভাইস তথ্য: আপনি কোন মডেলের ফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার করছেন।
৮. কেনাকাটার অভ্যাস: আপনি অনলাইনে কী কিনছেন বা কী কিনতে চাইছেন।
এসব তথ্য মিলিয়ে গুগল আপনার একটা ডিজিটাল প্রোফাইল তৈরি করে। তারা জানে আপনার শখ কী, আপনার অসুখ-বিসুখ আছে কি না, এমনকি আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ কী!
এই তথ্য দিয়ে গুগল কী করে
এখন প্রশ্ন হলো, গুগল কি এই তথ্য দিয়ে আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করবে? না, ব্যাপারটা তেমন নয়। তারা মূলত এসব তথ্য ব্যবহার করে আপনাকে টার্গেটেড অ্যাড বা বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্য।
খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, আপনি হয়তো ফেসবুকে বা গুগলে একবার ‘জুতা’ লিখে সার্চ দিলেন। এর পর থেকে আপনি যে সাইটেই যান, শুধু জুতার বিজ্ঞাপন দেখতে পান। এটাই হলো গুগলের খেলা। তারা আপনার তথ্য ব্যবহার করে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করে।
কিন্তু সমস্যা হলো, এসব তথ্য অনেক সময় ডেটা ব্রোকারদের হাতেও চলে যায়। আর একবার আপনার ব্যক্তিগত তথ্য ইন্টারনেটের খোলাবাজারে চলে গেলে, তা হ্যাকার বা স্ক্যামারদের হাতে পড়ার ঝুঁকি থাকে। ইতিমধ্যে গুগলের বিরুদ্ধে এই গোপনীয়তা লঙ্ঘনের দায়ে মামলাও হয়েছে।
তাহলে কোন ব্রাউজার ব্যবহার করবেন
ভয়ের কিছু নেই। ক্রোমের বাইরেও এমন কিছু দারুণ ব্রাউজার আছে, যেসব আপনার তথ্যের সুরক্ষা দেয়। চলুন, পরিচিত হই সে রকম কয়েকটি ব্রাউজারের সঙ্গে।
১. ব্রেভ (Brave)
আমার ব্যক্তিগত পছন্দের শীর্ষে আছে ব্রেভ। এটি ক্রোমের মতোই দেখতে। কাজও করে প্রায় একই রকম। কারণ, এটি ক্রোমিয়ামের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, কিন্তু এর চরিত্র ক্রোমের উল্টো
গোপনীয়তা: ব্রেভ আপনার কোনো ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে না।
অ্যাড-ব্লকার: এতে বিল্ট-ইন অ্যাড ব্লকার আছে। অর্থাৎ বিরক্তিকর বিজ্ঞাপন ছাড়াই আপনি ব্রাউজ করতে পারবেন।
গতি: যেহেতু এটি ট্র্যাকার আর বিজ্ঞাপন লোড করে না, তাই এটি ক্রোমের চেয়ে অনেক দ্রুত বা ফাস্ট।
সুবিধা: ক্রোমের সব এক্সটেনশন এখানেও ব্যবহার করা যায়।
২. টর ব্রাউজার (Tor Browser)
আপনি যদি জেমস বন্ডের মতো সর্বোচ্চ গোপনীয়তা চান, তবে টর আপনার জন্য। এটি আপনার আইপি অ্যাড্রেস বা লোকেশন লুকিয়ে ফেলে। আপনার ইন্টারনেট ট্রাফিককে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সার্ভারের মধ্য দিয়ে ঘুরিয়ে আনে, ফলে আপনাকে ট্রেস করা বা খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব।
অসুবিধা: এটি সাধারণ ব্যবহারের জন্য একটু ধীরগতির। প্রতিদিনের ফেসবুক বা ইউটিউবের জন্য এটি আদর্শ নয়, তবে গোপন কাজের জন্য সেরা।
৩. ফায়ারফক্স (Firefox) যাঁদের ব্রেভ বা টর পছন্দ নয়, তাঁরা চোখ বন্ধ করে ফায়ারফক্স ব্যবহার করতে পারেন। এটি মজিলা নামের এক অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের তৈরি। যেহেতু এরা ব্যবসার জন্য তৈরি হয়নি, তাই আপনার তথ্য বিক্রি করার প্রয়োজন নেই এদের।
সেটিংস: ফায়ারফক্সের ডিফল্ট সেটিংসে কিছু ট্র্যাকিং অন থাকে। তবে আপনি চাইলে ‘uBlock Origin’ বা ‘HTTPS Everywhere’-এর মতো এক্সটেনশন ব্যবহার করে একে দুর্ভেদ্য দুর্গ বানিয়ে নিতে পারেন।
নিজেকে সুরক্ষিত রাখার ৫টি টিপস
শুধু ব্রাউজার বদলালেই হবে না, অনলাইনে নিরাপদ থাকতে হলে আপনাকে স্মার্ট হতে হবে। বব গার্লির দেওয়া এসব টিপস মেনে চলুন—
১. কাজ ভাগ করুন: অফিসের কাজের জন্য এক ব্রাউজার আর ব্যক্তিগত কাজের জন্য আলাদা ব্রাউজার ব্যবহার করুন।
২. সার্চ ইঞ্জিন বদলান: গুগলের বদলে ‘DuckDuckGo’ বা ‘Startpage’ ব্যবহার করুন। এরা আপনার সার্চ হিস্ট্রি জমা রাখে না। ব্রেভ ব্রাউজারের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিনও বেশ ভালো।
৩. ভিপিএন (VPN): রেস্তোরাঁ বা বিমানবন্দরের মতো স্থানে পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহারের সময় অবশ্যই ভিপিএন ব্যবহার করুন।
৪. পাসওয়ার্ড ম্যানেজার: সব জায়গায় একই পাসওয়ার্ড দেবেন না। মনে রাখতে কষ্ট হলে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার অ্যাপ ব্যবহার করুন।
৫. আপডেট: ব্রাউজার এবং ফোন সব সময় আপডেট রাখবেন। আপডেটের মাধ্যমেই সিকিউরিটি প্যাচগুলো ঠিক করা হয়।
২০০৮ সাল থেকে আমরা অনেকেই ক্রোম ব্যবহার করে আসছি। এর মায়া এবং সুযোগসুবিধা ত্যাগ করা কঠিন। কিন্তু ভেবে দেখুন, আপনার ব্যক্তিগত জীবনের সব খবর একটা
মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? এখন সিদ্ধান্ত আপনার।
ব্রেভ বা ফায়ারফক্স ব্যবহার করা শুরু করলে দেখবেন, আপনার জীবনটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। বিজ্ঞাপন নেই, ট্র্যাকিং নেই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আপনি এক ক্লিকেই ক্রোমের সব পাসওয়ার্ড আর বুকমার্ক নতুন ব্রাউজারে নিয়ে আসতে পারবেন।
তাই আজই সিদ্ধান্ত নিন। আপনি কি গুগলের পণ্য হয়ে থাকবেন, নাকি নিজের তথ্যের মালিক নিজেই হবেন?
সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট