ইস্ট ওয়েস্টের উপাচার্য: এটা শুধুই আরও একটি চাকরি নয়

অধ্যাপক শামস্ রহমান ২০২১ ও ২০২২ সালে পরপর দুই বছর বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ২ শতাংশ স্কলারের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। এ বিষয়ে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একজন বিশেষজ্ঞ। তাঁর ২৫০ টিরও বেশি গবেষণা নিবন্ধ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইনফরমেশন সিস্টেমস অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট’-এর সহযোগী সম্পাদক। সেই সঙ্গে ১৬টি আন্তর্জাতিক জার্নালের এডিটরিয়াল বোর্ডের সদস্য। গবেষণার জন্য দেশে-বিদেশের বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্ত এই শিক্ষাবিদ বর্তমানে ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. সাইফুল্লাহ

প্রথম আলো:

উপাচার্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন প্রায় এক মাস হলো। দায়িত্ব নেওয়ার সময় আপনার মাথায় কী চলছিল

চল্লিশ বছরের বেশি সময় প্রবাসে থেকেছি। এর মধ্যে যে দেশে আসিনি, তা নয়। ঘন ঘনই আসা হয়েছে। প্রবাসে অনেক দক্ষ শিক্ষক আছেন। তুলনামূলকভাবে দেশে সংখ্যাটা কম। আর এই জায়গায় অনেক কিছু করার আছে—এই ভাবনাই আমাকে উদ্দীপনা ও সাহস জুগিয়েছে। খুব নির্দিষ্টভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আমি কিছু করতে চাই। এটা আমার কাছে শুধুই আরও একটি চাকরি নয়।

প্রথম আলো:

এখন পর্যন্ত অভিজ্ঞতা কেমন?

শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, সহযোগিতা করার জন্য তাঁরা বেশ উদ্‌গ্রীব। শিক্ষার্থীরাও খুবই সক্রিয়। যোগদানের তিন দিনের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিকমিউনিকেশন ক্লাবের আয়োজনে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংশগ্রহণকারীরা এসেছেন, সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রি থেকে বিচারকেরা এসেছেন। দেখে বেশ ভালো লাগল। কারণ, এখানে আমি নির্দিষ্টভাবে যে কাজগুলো করতে চাই, তার মধ্যে একটি হচ্ছে, শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির যোগাযোগ স্থাপন। আমার মনে হয়, কিছুটা সহযোগিতা পেলে শিক্ষার্থীরাই এই যোগাযোগটা গড়ে তুলতে পারবেন।

অধ্যাপক শামস্ রহমান
ছবি: সুমন ইউসুফ
প্রথম আলো:

আপনার শিক্ষাজীবন বা কর্মজীবনের এমন কোনো ঘটনা কি বলতে পারেন, যা আপনাকে খুব অনুপ্রাণিত করেছিল?

আমি তখন মাস্টার্স শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ) সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছি। একদিন আমাদের ওখানে এলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম। তিনি বারডেম হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা। সে সময় প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ছিলেন আইবিএর পরিচালক। তিনি আমাদের ডেকে পাঠালেন। অধ্যাপক ইব্রাহিম বললেন, ‘আমি আমার হাসপাতালে একটা কার্যকর ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম দাঁড় করাতে চাই। আমাদের এখানে ডায়াবেটিস পরীক্ষার জন্য বহু মানুষ দীর্ঘ লাইন ধরে অপেক্ষা করেন। কাজটা সময়সাপেক্ষ হয়ে যায়। তাঁদের কীভাবে আমরা আরও সহজে সেবা দিতে পারি?’

আমার মনে হলো, এটা একটি দারুণ প্রকল্প, যেখানে একাডেমি ও ইন্ডাস্ট্রির যোগাযোগ ও সমন্বয় ঘটবে। তিন মাস ধরে আমরা কাজ করলাম। সব শেষে অধ্যাপক ইব্রাহিমকে একটি প্রতিবেদন দিলাম। ফলে তাঁদের সেবার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রি এবং একাডেমি মিলে কাজের এই অভিজ্ঞতা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। এমনটাই আমি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতেও করতে চাই। এ–জাতীয় কিছু প্রকল্পের কাজ ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এরই মধ্যে সম্পন্ন করেছে। কিছু কাজ চলছে; কিন্তু এটাকে আরও ত্বরান্বিত করার সুযোগ আছে।

প্রথম আলো:

ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে এ যোগাযোগটা আসলে কেমন হবে

সংক্ষেপে আমার দর্শন হলো, ‘ইনসাইড আউট, আউটসাইড ইন।’ অর্থাৎ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী পড়াচ্ছি, কীভাবে পড়াচ্ছি, কী গবেষণা করছি, এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডাস্ট্রি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। আবার ইন্ডাস্ট্রি পর্যায়ে গবেষণাটা কাজে লাগিয়ে সেই অভিজ্ঞতা শিক্ষা পাঠ্যক্রমে যথাযথভাবে কাজে লাগানো। এতে করে পাঠ্যক্রম ও গবেষণা—দুটিকেই ক্রমে উৎকর্ষের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

গবেষণায় আপনার বিস্তৃত অভিজ্ঞতা আছে বলে জানি। শিক্ষার্থীরা আপনার এই অভিজ্ঞতা থেকে কীভাবে সাহায্য পেতে পারেন?

সাপ্লাই চেইন অ্যান্ড ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট–বিষয়ক একটি স্বনামধন্য জার্নালে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি অন্তত ১৬টি বিশ্বমানের জার্নালের এডিটোরিয়াল বোর্ডে আমি আছি। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি পরিকল্পনা আছে। লক্ষ্য করবেন, দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই কোনো না কোনো জার্নাল বের করছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের নিজ নিজ জার্নাল বের না করে প্রথম সারির কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে এই অঞ্চলের জন্য মানসম্মত একটি জার্নাল কি আমরা বের করতে পারি? যেখানে একটি আন্তর্জাতিক এডিটোরিয়াল বোর্ড থাকবে। বোর্ডের সদস্যরা যাচাই-বাছাই করবেন। শুরুতে আমরা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে অর্থায়ন করতে পারি। ক্রমে জার্নালের মানের উন্নতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবে। এ কাজটি আমি করতে চাই। স্বল্প মেয়াদে হয়তো সম্ভব হবে না। তবে ভিত্তিটা গড়ে দিয়ে যেতে চাই। যেন পরবর্তীকালে অন্যরা কাজটি এগিয়ে নিতে পারেন। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিনিময় (এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম)–এর মাধ্যমে যোগাযোগ বাড়াতে চাই।

প্রথম আলো:

কী মনে হচ্ছে? আপনার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ কী হবে?

চ্যালেঞ্জ অনেক আছে। তবে এগুলোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে না দেখে আমি ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখি। কারণ, বাধা যদি না থাকে; তাহলে বাধা অতিক্রম করার কোনো প্রচেষ্টা থাকে না। আমি মনে করি, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। গতানুগতিকভাবে যা হয়ে এসেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে, নতুন কিছু নতুনভাবে করার কথা ভাবতে হবে। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো গবেষণাটা বাড়ানো, র‍্যাঙ্কিংয়ে এগোনো। পাঁচ বছর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‍্যাঙ্কিংয়ের কথা ভাবত না। এখন ভাবছে। এমনকি অভিভাবকেরাও র‍্যাঙ্কিংয়ের কথা মাথায় রেখে সন্তানের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করছেন। শিক্ষার্থীরা আমার সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার। র‍্যাঙ্কিং পরিমাপের জন্য প্রধান কয়েকটি বিষয় হচ্ছে—একাডেমিক খ্যাতি, এমপ্লয়ার খ্যাতি এবং গবেষণায় সাইটেশন। সে জন্য উৎকৃষ্টমানের শিক্ষার পাশাপাশি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি মানসম্মত গবেষণার দিকে মনোযোগী।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

এ সময়ের তরুণদের জন্য আপনার পরামর্শ কী হবে?

আমরা শিক্ষার্থীদের যেমন হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে চাই, তেমনি তাঁদের চিন্তার জগৎ প্রসারিত করতে চাই। তাই প্রথমত শিক্ষার্থীদের একদিকে দক্ষ ব্যবস্থাপক হিসেবে দেখতে চাই। সেই সঙ্গে দেখতে চাই উদ্যোক্তা হিসেবে। তাঁদের ‘আউট অব দ্য বক্স’ সমাধান খুঁজতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমরা তরুণদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণ দেখতে চাই। আর সব শেষে বলব, তাঁরা যেন সমাজ এবং পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হন। এসব গুণ মিলিয়ে আমরা তরুণদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলায় ব্রত।