কোক স্টুডিওর গানে বাঁশি বাজিয়েছেন অনাথালয়ে বেড়ে ওঠা ক্যউপ্রু মার্মা, একই গানে গেয়েছেন তাঁর নানিও
কোক স্টুডিও বাংলায় সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘বাজি’ গানে বাঁশি বাজিয়ে বাজিমাত করেছেন রুমার ক্যউপ্রু মার্মা। এই গানের সূচনায় তাঁর নানিকেও মারমা ভাষায় গাইতে দেখা যায়। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ের এক অনাথালয়ে বেড়ে ওঠা এই তরুণের বংশীবাদক হয়ে ওঠার গল্প শুনেছেন সজীব মিয়া
দুই বছর বয়সে আমার বাবা মারা গেলেন। দাদাবাড়ি ছেড়ে আমাকে নিয়ে নানাবাড়িতে আশ্রয় নিলেন মা। আমাকে কোলেপিঠে বড় করতে থাকলেন নানি (ম্রাকোয়াইচিং মার্মা)। তিনি ভীষণ রসিক প্রকৃতির মানুষ। কাজের মধ্যেও আপন মনেই মারমা ভাষার গান করেন। ছোটবেলায় যখন কাঁদতাম, তখন নানি নেচে আমার কান্না থামানোর চেষ্টা করতেন। অনেক সময় আবার গান গেয়ে শোনাতেন, কখনো এমন সব ভঙ্গিমা করতেন, দেখে আমার মুখে হাসি ফুটত। আমার এই সুন্দর শৈশবে নানিকে ছেড়ে চার বছর বয়সে যেতে হয় লামায়। আমাকে রেখে আসা হয় সেখানকার কোয়ান্টাম শিশুকাননে।
এই অনাথালয়ে এসে নতুন এক পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় হলো। নানির গানবাজনা শুনে ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ঝোঁক। হোস্টেলে গানবাজনা শেখানো হতো দেখে দ্রুতই সেগুলো রপ্ত করতে থাকলাম। সেখানেই প্রথম হারমোনিয়াম হাতে নিই, গান, ছড়া শিখি।
শিশুকাননে আমি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আমার এক বন্ধুকে বাঁশি বাজাতে দেখে ইচ্ছা হলো, আমিও বাঁশি বাজাই। কিন্তু বাজার থেকে বাঁশি কেনার সামর্থ্য ছিল না। তাই মাপজোখ করে কয়েলের আগুনে বাঁশ পুড়িয়ে ছিদ্র করে নিজেই বাঁশি বানিয়ে ফেলি। সেই বাঁশিতে অনেকবার চেষ্টা করার পর একটু একটু করে সুর বেরোতে শুরু করে। তবে বাঁশি বাজানোর চেষ্টা বেশি দিন করতে পারিনি। এসএসসি পরীক্ষার চাপে সেই অনুশীলন আর চালিয়ে যাওয়া হয়নি।
এসএসসি পাসের পর বরিশালে কলেজে ভর্তি হই। বান্দরবান থেকে বরিশাল কেন? কারণ, আমার জুমচাষি মায়ের পক্ষে খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। তখন পাশে দাঁড়ান শিশুকাননেরই শিক্ষক আনোয়ার আল হক। আমার পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য মাসিক ফান্ডের ব্যবস্থা করেন তিনি। সেই সহায়তায় চলে আমার উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনা। আর সে সময় রাসেল হাওলাদার নামের শিশুকানন থেকে বেরিয়ে যাওয়া এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকতাম। তিনি তখন ব্রজমোহন কলেজে অনার্স করছিলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে থেকেই কলেজজীবন পার করি।
এইচএসসির পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেলাম। দুর্গম পাহাড় থেকে এসে কোনো দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখব, চিন্তাও করিনি। সেই শিক্ষকই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। তিন কড়ি চক্রবর্তী, এম এম মাসুম উজ্জামান ও কামরুম মুনির স্যারদের মতো মানুষদের সেই সহযোগিতায় আজও চলছি। এখন আমি ফাইনাল ইয়ারে পড়ি।
ছেলেবেলা থেকেই মায়ের কষ্ট দেখে বড় হয়েছি। এসব কষ্টের কথা কাউকে বলা যায় না। জীবনের সব কষ্ট থেকে খানিকটা সময় দূরে থাকার জন্য গান আর বাদ্যযন্ত্র বেছে নিই। স্কুলে ছেড়ে আসা বাঁশি আবার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে হাতে তুলে নিই। কিছুদিনের চেষ্টায় দেখি ভালোই বাজাতে পারি। কখনো উঁচু পাহাড়ে, কখনো নদীর তীরে, কখনো আবার বাড়ির সামনে বসে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের বারান্দায় বাজানো শুরু করলাম। সেসব মুহূর্ত ভিডিও করে ফেসবুকে পোস্ট করতাম। বেশ সাড়াও পেয়ে যাই। বাঁশির পাশাপাশি হারমোনিয়াম, ঢোল, গিটার, মেলোডিকা বাজানো রপ্ত করি।
এসব বাজাতে বাজাতে ‘দরবার’ নামে চট্টগ্রামের একটি ব্যান্ডের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে যাই। তাদের সঙ্গে নানা জায়গায় গিয়ে গান করি। তবে নিজের কাজগুলোও চালিয়ে যাই। বাড়ির মাচাংয়ে বসে একদিন নানিকে অনুরোধ করলাম গান গাইতে। তিনি গাইলেন আর আমি গিটার বাজালাম। সেই গানটা ফেসবুক পোস্ট করলে বেশ শেয়ার হয়। তখন সেটা (শায়ান চৌধুরী) অর্ণবদার নজরেও আসে। মেসেঞ্জারে নক দিয়ে আমাকে শুভকামনাও জানিয়েছিলেন তিনি। তাঁর শুভকামনা পেয়েও মুখ ফুটে বলতে পারিনি, ‘দাদা, আমার অনেক দিনের স্বপ্ন কোক স্টুডিওতে বাঁশি বাজানোর।’
আর কী আশ্চর্য! না বলার পরও কিন্তু গত বছরের মার্চে সেই সুযোগ এল।
মা আর নানির ঢাকা দেখা
আমার ব্যান্ডের ভোকালিস্ট মানিক জসিম ভাইয়ের সঙ্গে সংগীত পরিচালক ইমন চৌধুরীর টিমের যোগাযোগ আছে। একবার ঢাকায় গেলে আমার সঙ্গেও পরিচয় হয়। ২০২৪ সালের শুরুতে কোক স্টুডিওর পক্ষ থেকে হঠাৎ ইমন চৌধুরীর টিমের শহীদুল মানিক ভাইয়ের কল পাই। পাহাড়-সমুদ্র থিমের একটি গানের জন্য আমাকে ঢাকায় আসতে বললেন। আমি মহা আনন্দে ঢাকায় চলে এলাম।
প্রায় ১০ দিন কেটে গেল। সেদিন ছিল শুক্রবার। ইমন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছি। একফাঁকে নানির গাওয়া গানের সেই ভিডিও তাঁকে দেখাই। দেখেই তিনি অবাক। এই ভিডিও আগেই তাঁকে দেখিয়েছিলেন অর্ণবদা। কিন্তু সেটা যে আমার ভিডিও, আর সেই নারী যে আমার নানি, ইমন ভাই তা জানতেন না। এবার দেখেই বললেন, ‘তোমার নানিকে নিয়ে আসো।’
কিন্তু বললেই কি আনা যায়! তখন দুপুর। নানি আর মা তখনো জুমে। আমি এদিকে উত্তেজনায় কাঁপছি। জীবনে প্রথমবার মা আর নানিকে ঢাকায় আনার সুযোগ। সন্ধ্যায় কল করে তাঁদের ঢাকায় আসতে বললাম। দুজনই আনন্দে উদ্বেল। পরদিন সকালেই তাড়াহুড়া করে বান্দরবান গেলেন। ঢাকা থেকেই তাঁদের জন্য রাতের বাসের টিকিট কেটে দিলাম। নানি আর মা এলেন ঢাকায়।
কোক স্টুডিওর গানের কাজে ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন, এমন অনেকের জন্য ধানমন্ডিতে হোটেলে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। নানি আর মায়ের জন্য হোটেল বুক করা হলো। আমিও সেদিন স্টুডিও ছেড়ে তাঁদের সঙ্গে হোটেলে উঠে গেলাম। পাহাড়ে পুরো জীবন কাটানো দুজন মানুষের জন্য এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। সবকিছুই তাঁদের কাছে বিস্ময়। আমাদের বাড়িতে টেলিভিশন নেই, হোটেল রুমে টেলিভিশন দেখছেন। নানি একবার লিফটে উঠে কোনো ভাড়া দেওয়া লাগে না শুনে অবাক। খেতে বসে প্রমাণ সাইজের চিংড়ি পাতে নিয়েও অবাক, এত বড় চিংড়ি হয়!
এরপর নানির রেকর্ডিং শুরু হলো। গানের স্কেলটা আমার ভিডিওটার থেকে চার নোট ওপরে ছিল। আমি চিন্তায় পড়ে যাই, নানি পারবে তো! কিন্তু ইমন ভাই আশ্বস্ত করলেন। প্রথমে একটু কষ্ট হলেও দ্রুত মানিয়ে নিলেন নানি। মাত্র দুই টেকেই রেকর্ড শেষ হয়ে যায়। এত সহজে, এত সুন্দরভাবে নানি গাইলেন যে আমি নিজেই অবাক।
এবার ঠোঁট মিলিয়ে শুটিং। সে সময় আরেক চ্যালেঞ্জ। এই কাজে তো নানি অভ্যস্ত নন, গান তো নিজের মতো করে গেয়ে ফেলেছেন, ঠোঁট মেলানোর ব্যাপারটা আর ধরতে পারছেন না। পরে আমি গিয়ে বোঝাই, ‘তুমি গাইবে, তবে যে গানটা বাজছে, তার গানের সঙ্গে মিলিয়ে।’
কয়েকবার চেষ্টার পর দারুণভাবে সে কাজও করে ফেললেন নানি।
একই গানে নানির কণ্ঠের সঙ্গে বাঁশি বাজাতে পারার মতো আনন্দের ঘটনা আমার জীবনে তেমন নেই।