মনের ধকল সামলে পড়ালেখায় ফিরব কীভাবে
দীর্ঘ বিরতির পর আবার খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। মাঝখানের এই সময়ে ছাত্রছাত্রীদের মনের ওপর দিয়ে বড় ঝড় বয়ে গেছে। কীভাবে মানসিক দিক দিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ফিরবেন পড়ালেখায়? লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট রাউফুন নাহার
সম্প্রতি বাংলাদেশ যে রাজনৈতিক ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছে বা এখনো যাচ্ছে, তাতে তরুণদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। ফলে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিও তাদের বেশি। দীর্ঘ সময় এই মানসিক অস্থিরতা সঙ্গে নিয়ে চললে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এখন সময় মানসিক আঘাত সামলে নিয়ে স্বাভাবিক জীবন ও কাজকর্মে ফেরার। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের দিক থেকে যেমন সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা প্রয়োজন, তেমনি অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
করণীয় কী
রাজনৈতিক ট্রমা ও এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকা: কোনো রাজনৈতিক ঘটনা ও সহিংসতায় প্রভাবিত হয়ে আমাদের ভেতরে যে আতঙ্ক, অসহায়ত্ব, মানসিক উত্তেজনা, স্তব্ধতা ও অনিশ্চয়তার জন্ম হয়, তাকে রাজনৈতিক ট্রমা বলে। এ ধরনের ঘটনায় আমাদের স্বাভাবিক জীবন ও কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। সেই সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহিংসতার মুখোমুখি হওয়ায় সংকট–পরবর্তী মানসিক চাপের বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়, যেমন ভয়, রাগ, অনুতাপ, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, বিষণ্নতা, অসহায়ত্ব, ঘুমের সমস্যা, অনিরাপদ বোধ করা, মাথাব্যথা, ক্লান্তি, ক্ষুধামান্দ্য, কাজে মনোযোগ দিতে না পারা, আক্রমণাত্মক আচরণ করা, প্রতিশোধপ্রবণ হওয়া, ভিন্নমতের মানুষকে সহ্য করতে না পারা ইত্যাদি। এসব উপসর্গ সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং তা মোকাবিলায় সচেষ্ট থাকা শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সহযোগিতা করবে।
স্ক্রিন টাইম কমানো: সংকট ছাড়া অন্যান্য সময়েও অতিরিক্ত ‘স্ক্রিন টাইম’ আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। আর সংকটকালে টেলিভিশন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া সহিংসতার খবর ও ঘটনা সম্পর্কে অনবরত তথ্য আমাদের মস্তিষ্ককে স্থির হতে দেয় না। তাই দৈনন্দিন কাজে ফিরতে হলে সবার আগে প্রয়োজন স্ক্রিন টাইম কমানো—ইন্টারনেট থেকে বেরিয়ে নিজের জীবন, কাজ ও সম্পর্কগুলোর যত্ন নেওয়া।
কাজগুলোকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করা ও অগ্রগতি খেয়াল করা: সংকট কাটিয়ে কাজে ফেরার জন্য একটি বাস্তবসম্মত রুটিন করা যেতে পারে; অর্থাৎ যে রুটিন অনুসরণ করা আমার সাধ্যের মধ্যে। শুরুতেই নিজেকে কাজের চাপ দিলে, জমে থাকা পড়ালেখা বা কাজগুলোকে একসঙ্গে করতে চাইলে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না, বরং হতাশার সৃষ্টি হয়। তাই কাজগুলোকে ছোট অংশে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে এবং একটা একটা করে সম্পন্ন করা যেতে পারে।
পর্যাপ্ত ঘুম: পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের মনকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে, কর্মদীপ্ত রাখে। ভালো ঘুমের জন্য ঘুমের নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠা এবং একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন। দিনের বেলা ঝকঝকে আলোয় থাকা; কিন্তু রাতে ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা আগে ঘরের আলো কমিয়ে দেওয়া এবং মুঠোফোন, কম্পিউটার ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ করা—এটিও একটি স্বাস্থ্যকর চর্চা।
সুষম খাদ্যাভ্যাস: খাদ্যাভ্যাস আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে। প্রতি বেলার খাবারে অন্তত ৫০ শতাংশ শাকসবজি-ফলমূল রাখা উচিত। বাকি ৫০ শতাংশের মধ্যে ২৫ শতাংশ আমিষ (মাছ, মাংস, ডাল, ডিম ইত্যাদি) ও ২৫ শতাংশ শর্করা (ভাত, রুটি, পাস্তা ও বিভিন্ন শস্যদানা) জাতীয় খাবার রাখা দরকার। সঙ্গে কিছুটা দুগ্ধজাতীয় খাবারও রাখা যেতে পারে, তবে তা আবশ্যক নয়।
মন শান্ত রাখা: মন অশান্ত হলে শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম, মনোযোগী ধ্যান বা যোগাসন করে মন শান্ত করা যেতে পারে। নিয়মিত শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম আমাদের মানসিক চাপ ও অস্থিরতা কমায়, মানসিক প্রশান্তি বাড়ায় এবং শরীর ও মস্তিষ্ককে শিথিল করে। আমাদের দৈনন্দিন কাজে মনোযোগী থাকতে সহযোগিতা করে।
কাছের মানুষের তালিকা: দুঃসময়ে আমাদের মন অবচেতনভাবেই কাছের মানুষের সন্ধান করে বেড়ায়, যারা মনোযোগ দিয়ে আমাদের শোনে, মাথায় মমতার হাত বুলায় এবং আমাদের অনুভূতি ও প্রয়োজনগুলো বোঝে। বিপদের সময় তাদের নামগুলো অনেক সময় আমাদের মাথায় আসে না। এ জন্য আমাদের কাছে একটি তালিকা থাকতে পারে, যেখানে কাছের মানুষের নামগুলো থাকবে।
আন্তরিক যোগযোগ: রাজনৈতিক ট্রমার একটি অন্যতম বড় ক্ষতি হলো মতের অমিলের কারণে কাছের বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীকে হারানো। একটি সংকটে নানা পক্ষ (পক্ষ, বিপক্ষ, নিরপেক্ষ, উভয় পক্ষ, কেবলই ভুক্তভোগী ইত্যাদি) থাকতে পারে। নানা দিক থেকে নানা মত আসতে পারে। নিজের মতের সঙ্গে অন্য কারও মত না মিললে আক্রমণাত্মক না হয়েও আন্তরিকভাবে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে। ব্যক্তিগত সম্পর্ককে সুরক্ষিত রেখেও ভিন্নমত পোষণ করা বা গঠনমূলক সমালোচনা করা যেতে পারে। মানসিক অস্থিরতার কারণে তা সম্ভব না হলে সেই সম্পর্ক থেকে সাময়িক বিরতি নেওয়া যেতে পারে বা এড়িয়ে চলা যেতে পারে। মুহূর্তের উত্তেজনায় ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা: সংকট কাটিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক জীবন ও কাজে ফেরার জন্য পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মানসিকভাবে আরাম বোধ করতে এবং যথাযথ বিকাশের জন্য বাড়িতে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য বিকাশ–সহায়ক পরিবেশ থাকা আবশ্যক।
সংকট–পরবর্তী সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করার পরও যদি মানসিক চাপ না কমে, তাহলে পেশাগত কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপি সেবা নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কাউন্সেলিং সেবার ব্যবস্থা করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।