‘লিখাপড়া ছাড়া আর কী লিয়্যা হামরা আগাইতে পারবো’

কলেজ মাঠে মায়ের সঙ্গে স্বপ্নদীপ
ছবি: প্রথম আলো

কোনো দিন শহর দেখেনি ছেলে। তাই শহর দেখাতে নিয়ে এসেছেন মা । শুধু তো শহর দেখা না, পূজার আগে মায়ের কাছে এবার একটি বিশেষ বায়নাও ধরেছিল স্বপ্নদীপ। পূজার নতুন পোশাকটি এবার তাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে কিনে দিতে হবে। কোনো দিন কিছু না চাওয়া লাজুক ছেলেটি যখন এই আবদার করেছে, মা কী তা না রেখে পারেন! ছেলেকে নিয়ে তাই শহরে এসেছেন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার খেতমজুর নারী কল্পনা রাজোয়ার। সদর উপজেলার বরেন্দ্রভূমির ঝিলিম ইউনিয়ন পরিষদের টংপাড়ার বাসিন্দা এই মা ছেলে।

নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজে তাঁদের সঙ্গে দেখা। কথা বলতে গিয়েই জানা গেল কল্পনা রাজোয়ার আর তাঁর অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলে স্বপ্নদীপের এই শহর ঘোরার গল্প। ছেলে তো কলেজে না, মার্কেটে যেতে চেয়েছে, তাহলে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন, জানতে চাইলাম। কল্পনা রাজোয়ার বলেন, ‘ব্যাটাকে লিয়া হামার মেলা স্বপ্ন। লিখাপড়হা শিখ্যা যানি ব্যাটা হামার মানুষের মত মানুষ হোইতে পারে। এ লাগি বড় এই কলেজটা দেখাইতে লিয়া আইস্যাছি। ব্যাটার মনে জানি বড় কলেজে পড়ার স্বপ্ন জাগে। তুবেতো চোখ-মুখ ফুটবে।’

কলেজের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন কল্পনা ও তাঁর সন্তান স্বপ্নদীপ
ছবি: প্রথম আলো

কলেজে ঢুকে প্রথমে দেখালেন শহীদ মিনার। এতবড় শহীদ মিনার কখনো দেখেনি ছেলে। কল্পনা অবশ্য এখানে আগেও এসেছেন। এই শহীদ মিনারে আয়োজিত তিনটি কর্মসূচিতে তিনি গ্রামের অন্য নারীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। স্থানীয় প্রগতিশীল নারীদের সংগঠন ‘জাগো নারী বহ্নিশিখা’ আয়োজিত আন্তর্জাতিক নারী দিবস, নাচোলের ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্রের স্মরণ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার গল্প ছেলেকে শুনিয়েছেন। এ ছাড়াও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের ওপর নিপীড়নের প্রতিবাদ জানাতে, অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অংশ নিতে ২০ কিলোমিটার দূর থেকে বেশ কয়েকবার এই শহরে আসারও গল্প শোনালেন কল্পনা। শেষে ছেলেকে কলেজের গোটা ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে একটু জিরিয়ে নিতে বসেন প্রশাসনিক ভবনের সামনে শানবাঁধানো আমগাছতলায়।

কল্পনার একটি মেয়েও আছে, নাম সাথী রাজোয়ার। মেয়েটি পড়ছে পঞ্চম শ্রেণিতে। কল্পনা বলেন, ‘বেটি আছে বাড়িতে। অকেও একদিন এই কলেজ দেখাইতে লিয়া আসবো। আপনারা হামার ব্যাটা-বেটির লাগি আশীর্বাদ করিয়েন, অরা যানি লিখাপড়া শিখ্যা বড় হোইতে পারে। হামরা হাতে খাটি প্যাটে খাই। লিখাপড়া ছাড়া আর কী লিয়্যা হামরা আগাইতে পারবো।’

মায়ের সব কথা মন দিয়ে শুনছিল স্বপ্নদীপ রাজোয়ার। পূজার পোশাক কিনতে উঠে যাওয়ার আগে মায়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলাম, জবাবে শুধু একটা লাজুক হাসিই মিলল।