তোমার অবহেলা আমাকে ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে দিল না

‘দ্বিতীয় বর্ষের রেজাল্ট আশানুরূপ হয়নি। বাবা বাড়িতে খুব অশান্তি করেছে। ভালো সিজিপিএ নিয়ে পাস করতে হবে। আমরা সম্পর্কটাকে আর বড় না করি। জীবন নিয়ে তুমিও একটু সিরিয়াস হও। আমাকে আর বিরক্ত না করলে খুশি হব। ভালো থেকো।’ মেসেঞ্জারে কথাগুলো লিখে পাঠায় ঋতু।

ভেবেছিলাম বাবার বকা খেয়ে খারাপ লাগা থেকে কথাগুলো লিখেছে। কিন্তু পরপরই ব্যবধানের দেয়াল তুলে দেয় ও। অবহেলার কষ্ট থেকে বাঁচতে চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা শেষ না করেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসি। আট মাস কেটে গেছে, আজও ফেরা হয়নি। মোবাইল, ইন্টারনেট সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের মতো আছি। বাবা-মা, পরিবার-পরিজন থাকলে এভাবে থাকা হয়তো সম্ভব হতো না। আরও আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে হতো। কিন্তু আশ্রমে বড় হয়েছি। মা-বাবা কাউকে দেখিনি। সার্টিফিকেটে যাদের নাম বহন করছি, আশ্রমের দাদুর মুখে শুনেছি, তাদের সন্তান ছিল না। তারা আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। পরে সন্তান হওয়ায় আশ্রমে রেখে যায়।

তাদের কোনো দোষারোপ করি না। এমনকি জন্মদাত্রী মায়ের প্রতিও কোনো অভিযোগ নেই। নিশ্চয়ই মায়ের কোনো উপায় ছিল না। না হলে মা কি কখনো সন্তানকে রাস্তায় ফেলে যেতে পারে? আবার এমনও হতে পারে, জন্মের সময় মা মারা গেছে। বাবা একা দায়িত্ব নিতে চায়নি। কিংবা অন্য কিছু। নানা ভাবনা আসে মনে। ভাবনা ফুরালে ঋতুর কথা মনে পড়ে। তাকে দেখতে ইচ্ছে করে। মাকেও ভীষণ অনুভব করি। মুখটা যদিও কখনো দেখিনি। তারপরও শেষ রাতে ঘুমের ঘোরে চোখে একটি মুখ ভেসে ওঠে। কিন্তু চোখ খুলে আর মনে করতে পারি না।

ঋতু আমার দুই ব্যাচ জুনিয়র। আমাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা। আমি কেমিস্ট্রি, ঋতু ফার্মেসি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরলে দেখা হবে, তখন কথা না বলে কী করে থাকব? ‘কন্ট্রোল নয়ন, কন্ট্রোল’ ভেতর থেকে তাগিদ বোধ করলেও নিয়ন্ত্রণ করতে কি পারব! ঋতুরই-বা দোষ কোথায়, জন্মপরিচয়হীন একটা ছেলেকে সজ্ঞানে কেউ কি ভালোবাসতে পারে? সে সম্ভ্রান্ত্র পরিবারের মেয়ে। বাবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার পরিবার কখনো আমাকে মেনে নেবে না। আচ্ছা, তাহলে সব দোষ কি আমার? কিন্তু আমি তো নিজের ইচ্ছেতে পৃথিবীতে আসিনি। তেমন নিয়ম থাকলে নিশ্চয়ই সৌভাগ্য নিয়েই আসতাম।

দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে কেউ।

ঋতু!

একদিন কথাপ্রসঙ্গে আমার এই ঠিকানা তাকে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, যখন কোথাও খুঁজে পাবে না, যদি বেঁচে থাকি তাহলে ওইখানে গেলে আমাকে পাবে। ঋতু ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ আমার এই ঠিকানা জানে না। চোখ-মুখটা শুকনা দেখাচ্ছে ঋতুর। বাস জার্নি করতে পারে না সে। আমার জন্য এত দূর এসেছে?

ঋতুর পায়ের কাছে বসে পড়ি, ‘বিশ্বাস করো নিজের চেয়েও তোমাকে বেশি ভালোবাসি। জন্মপরিচয়ের অজুহাতে আমাকে ছেড়ে দিয়ো না। তুমি ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই।’

—জন্মপরিচয়, জন্মপরিচয় করো কেন সব সময়? তোমার জন্মপরিচয় নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। বলদ! ভাবছিলাম অ্যাভয়েড করলে জীবন নিয়ে, ক্যারিয়ার নিয়ে সিরিয়াস হবা। কিন্তু গাধা সব ছেড়েছুড়ে টঙে এসে উঠছে।

আমার দুচোখ জলে টলমল।

চোখ মুছে দিতে দিতে ঋতু বলল, ‘আমায় যে ভালোবাসে, তার চোখে জল মানায় না। সে হবে পাহাড়ের মতো সমুন্নত। সূর্যের মতো তেজোদীপ্ত।’ ঋতুকে বুকের ভেতর জাপটে ধরি। ‘বোকামি ছেড়ে পড়ালেখায় মন দাও। একটা বছর শুধু শুধু নষ্ট করলা।’

—কথা দাও, কখনো ছেড়ে যাবে না। তোমার জন্য জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি।

—ভালোবাসি কি না, পরীক্ষা নিতে চাও। কী যেন বলেছিলে সেদিন?

জবাব দিই না। ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে ঋতু। তার ঠোঁট দুটো আমার ঠোঁট ছুয়ে দিতে যাওয়ার মুহূর্তে স্বপ্নে দেখা মুখটা অস্পষ্টভাবে চোখে ভেসে ওঠে। জন্মপরিচয় না থাকার কষ্টে বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। ‘আমরা কোনো ভুল করব না,’ বলে ঋতুকে দূরে সরিয়ে দিই।