এই শিক্ষার্থীরা অন্য রকম
সারা রাতের ভ্রমণক্লান্তি নিয়ে বান্দরবানের লামা যখন পৌঁছালাম, সূর্য মাত্র উঁকি দেওয়া শুরু করেছে। আমার সঙ্গী জ্যাকি মারমা। এ অঞ্চলেরই ছেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্নাতকোত্তরে পড়াশোনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিভিন্ন খেলাধুলার ইভেন্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলের পরিচিত মুখ।
মূলত এই তরুণের মাধ্যমেই পাহাড়ি জনপদের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমার পরিচয়। জ্যাকি সব সময় চায়, সে যেমন ওই দুর্গম জায়গা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পেরেছে, তার মতো আরও অনেকেই যেন উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়। বছর দুই আগে হঠাৎ একদিন কথায় কথায় প্রস্তাব দিল, ‘আপনি তো ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতির ব্যাপারে সাহায্য করেন, আমাদের পাহাড়ের ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করা যায় কি না দেখবেন?’
এমনিতেই পাহাড় আমাকে বেশ টানে। বছরে দু-তিনবার সবুজের মধ্যে হারিয়ে যেতে না পারলে দম বন্ধ হয়ে আসে। আবার পড়ানোর কাজটাও খুব উপভোগ করি। ভাবলাম, বাহ্, এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে!
একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমবার পাহাড়ের ওই শিক্ষার্থীদের এভাবে পড়াতে গিয়েছিলাম আজ থেকে দুই বছর আগে, আলীকদমে। সেই যে শুরু হলো, তারপর ভালো লাগার জায়গা থেকে আমিও আর পিছু হটিনি। এবার তো আলীকদম আর লামা দুইটা উপজেলাতেই ছড়িয়ে দিয়েছি কাজ।
বান্দরবানের লামার কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজ একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। একেবারে নার্সারি থেকে কলেজ পর্যন্ত বিনা বেতনে তাঁরা আবাসিক পদ্ধতিতে পড়াশোনা করায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের, যাদের অধিকাংশই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর। এই শিশুরা যেন ভবিষ্যতেও ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়, সেই সহায়তাও করেন তাঁরা।
এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে জনা ত্রিশেক ছাত্র। ঢাকায় এসে কোচিং করার মতো আর্থিক সংগতি কিংবা সুযোগ তাদের নেই। নিজেরা নিজেরাই পড়াশোনা করে, সঙ্গে সহযোগিতা করে জ্যাকিদের মতো প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। আর এবার যোগ দিলাম আমি। ক্লাসরুমে ঢুকেই চোখ চলে গেল ব্ল্যাকবোর্ডের এক কোণে। চক দিয়ে বড় করে লেখা—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার কত দিন বাকি। একটা করে দিন যায়, ওরা ডাস্টার দিয়ে মুছে সংখ্যাটাও নতুন করে লেখে। ভেতরের তাগিদ বাড়ানোর এক রকম পদ্ধতি। বাহ, বেশ তো!
বোর্ডের পাশে হাতে লেখা একটা কর্তব্য তালিকা। তারা নিজেরাই বানিয়েছে। একেকজনের নামের পাশে একেকটা বিষয়ের নাম লেখা। যেহেতু নিয়মিত মডেল টেস্ট দেওয়ার কোনো সুযোগ ওদের নেই, পরীক্ষা নেওয়ারও কেউ নেই, তাই পড়াশোনা যাচাই করার জন্য ওরা নিজেরাই প্রশ্ন বানায়।
সারা দিন ধরে চলল কর্মশালা। প্রথম ক্লাসটা নিলাম রুমে, পরেরটা পাহাড়ের ঢালে বসে উন্মুক্ত পরিবেশে। রাতে আবার লম্বা সময় ধরে চলল সেশন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজনই বেশি। আছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, চাক, খিও। আছে চট্টগ্রাম, বরিশাল, কুষ্টিয়া, খুলনা, মাগুরা, কুমিল্লা থেকে যাওয়া বাঙালি সন্তানও। প্রত্যেকের জীবনের গল্পেই চড়াই-উতরাই কম না।
রাতের সেশন যতক্ষণে শেষ করছি, ততক্ষণে পাহাড়ের বুকে সুনসান নীরবতা নেমে এসেছে। সারা দিনের ব্যস্ততার ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে তাই ওদের বললাম, চলো আমরা গান গাই। তবে শর্ত একটাই, নিজ নিজ ভাষায় গাইতে হবে। প্রাচুর্য চাকমা, সুব্রত চাকমা, অরবিশ চাকমা, প্রেসা খিঁওরা তাদের ভাষায় গান গাইল। মিজানুর, মিনহাজ উদ্দিন, ফরহাদরাও শোনাল আঞ্চলিক গান। সবাই মিলে হেসে–গেয়ে শেষ হলো দিনটা।
এখানে পড়েই কিন্তু অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে অন্য অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়ে যায়। পাহাড়ের মানুষ বলেই হয়তো ওরা সহজে হতাশ হয় না, ভয় পায় না। আবার হাসিমুখে কথা বলতেও ভোলে না। আমার সফরসঙ্গী জ্যাকি মারমার একটা গল্প শুনলেই অবাক হবেন। ২০১৬-১৭ সেশনে জ্যাকি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়, চাইলেই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কোটায় প্রথম সারির কোনো বিষয় বেছে নিতে পারত। কিন্তু জ্যাকি সেটা করেনি। তার মাথায় ছিল, ‘একটু পরের দিকের বিষয় হলেও একটা না একটা তো পেয়েই যাব। তার চেয়ে কোটা ব্যবহার করে অন্য একটা পাহাড়ি ছেলে সুযোগ পাক।’ নিজের মানুষদের জন্য যে এভাবে ভাবা যায়, জ্যাকিদের না দেখলে হয়তো জানতামই না।
পরদিন লামা থেকে বিদায় নিয়ে একটা বাইকের পিছে চড়ে ছুটলাম আলীকদমের পথে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন নুরুল ছাফা ভূঁইয়া। এলাকার সবাই ডাকে ‘বাবু ভাই’ বলে। পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রামের একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আলীকদমে হাইস্কুল আর কলেজের বাচ্চাদের পড়ান ২০১৪ সাল থেকে। আগে শুধু কলেজ পর্যন্তই পড়াতেন। ২০২০ সাল থেকে শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতির জন্য পড়ানো। পাহাড়ের যেসব শিক্ষার্থী টাকাপয়সা খরচ করে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে কোচিং করতে যেতে পারে না, তাদের ভরসা বাবু ভাই। বাবু ভাই নিজে ক্লাস নেন, আবার জ্যাকি মারমাদের মতো শিক্ষার্থীদেরও আমন্ত্রণ করে নিয়ে যান। সম্মানী হিসেবে শিক্ষার্থীরা খুশি হয়ে যা দেয়, বাবু ভাই সেটাই হাসিমুখে গ্রহণ করেন। এবার গিয়ে দেখলাম, তাঁর ওখানেও আছে জনা পঁচিশেক শিক্ষার্থী।
ঢাকা থেকে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে গিয়েছিলাম এই শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দিতে। অথচ আমি নিজেই একরাশ অনুপ্রেরণা নিয়ে ফিরেছি।
আবার যাব ওদের কাছে।