অভিবাসী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোয় সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্টের পুরস্কার পেলেন বাংলাদেশের নাজমুল

বাংলাদেশের নাজমুল খান সিঙ্গাপুরের অভিবাসী শ্রমিকদের আপনজন। বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের শিক্ষা ও দক্ষতা বাড়াতে তাঁর আছে নানা উদ্যোগ। সেবামূলক সেসব কাজের জন্য দেশটির ‘প্রেসিডেন্টস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন তিনি। পেশায় ‘সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার’ নাজমুলের গল্প শুনেছেন কবীর হোসাইন

অভিবাসী শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে কাজ করেন নাজমুল খান
ছবি: সংগৃহীত

‘সেই বিকেলের কথা কোনো দিন ভুলব না। মানুষের বিপুল ভালোবাসা, বিদেশবিভুঁইয়ে এমন পুরস্কার—সবকিছুর মূলেই সেদিনের সেই বিকেল।’

তারপর মুঠোফোনের ওপ্রান্ত থেকে ২০০৭ সালের সেই বিকেলের গল্প বলতে শুরু করেন নাজমুল খান। বাংলাদেশে ছুটি কাটিয়ে সেদিন সিঙ্গাপুরে ফিরছিলেন তিনি। বিমানবন্দরে ঢোকার আগমুহূর্তে দেখলেন, একজন নারী উদ্‌ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করছেন। হাতে একটি পিঠার বাক্স। কৌতূহলী হয়ে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সেই নারী জানালেন, সিঙ্গাপুরগামী কাউকে খুঁজছেন তিনি। পিঠার বাক্সটি পাঠাতে চান। ছেলের নাম আর মুঠোফোন নম্বরটা কেবল দিতে পারলেন ভদ্রমহিলা। তাঁকে আশ্বস্ত করে বাক্স নিয়ে  সিঙ্গাপুরে এলেন নাজমুল খান। ভ্রমণক্লান্তি  কাটিয়ে পরদিন বিকেলে দিতে গেলেন বাক্সটি। প্রাপকের হাতে বাক্সটা দিয়ে তাঁর মায়ের নম্বর ডায়াল করে তাঁর হাতে দিলেন। কানে ফোন ধরেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন ছেলেটি। সেদিন সকালেই মারা যান তাঁর মা।

ফিরোজদের নিয়ে ভাবনা

নাজমুলের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সিঙ্গাপুরে নেমেই কেন সঙ্গে সঙ্গে এলেন না! হয়তো ছেলেটি মায়ের সঙ্গে আরেকটু কথা বলতে পারতেন। হয়তো বলতে পারতেন মা, ভালো হয়েছে পিঠার স্বাদ। ছেলেটিকে সান্ত্বনা দিলেন। কথা বললেন দীর্ঘক্ষণ। তাঁর বাড়ি সাতক্ষীরা, নাম ফিরোজ। ১১ বছর হলো সিঙ্গাপুরে আছেন। নির্মাণশ্রমিক হিসেবে এসেছিলেন, এক দশক পরও সেই নির্মাণশ্রমিকই রয়ে গেছেন। কাজ, পারিশ্রমিক বা জীবনযাত্রা—কোনো কিছুরই উন্নতি হয়নি। বিষয়টি নাজমুলকে ভাবিয়ে তুলল। কেবলই মনে হতে লাগল, এই দ্বীপদেশে এমন অসংখ্য ফিরোজ ছড়িয়ে রয়েছে। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, অমানুষিক পরিশ্রম, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, সুন্দর জীবনের সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত, সর্বোপরি নীরস-নিরানন্দের জীবন কাটানো এই ফিরোজদের জন্য কিছু করা জরুরি।

অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করতে স্বেচ্ছাসেবী দল তৈরি করেছেন নাজমুল
ছবি: সংগৃহীত

যাত্রা হলো শুরু

টাঙ্গাইলের মানুষ নাজমুল খান। ঢাকা কলেজে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন সিঙ্গাপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ে। সিঙ্গাপুরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে চাকরি করেন। সাতপাঁচ না ভেবে কাজে নেমে পড়লেন। শুরুতে একা একা, নিজের মতো করে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে লাগলেন। কাজের পরিধি বাড়তে লাগল। বাড়তে থাকল পরিচিতি। রেডক্রস সিঙ্গাপুর, মাইগ্রেন্ট কমিউনিটি, সিঙ্গাপুর কিডনি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ হাইকমিশনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করলেন। এরপর ২০১৩ সালে সিঙ্গাপুর-বাংলাদেশ সোসাইটি এবং বাংলাদেশ বিজনেস চেম্বারের সঙ্গে যুক্ত হলেন। অভিবাসীদের সমস্যা, উত্তরণের পথসহ বিভিন্ন বিষয় সেখানে তুলে ধরার সুযোগ হলো।

সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট হালিমা ইয়াকুবের হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন নাজমুল
ছবি: সংগৃহীত

২৪ এশিয়া

তত দিনে নাজমুলের একটি স্বেচ্ছাসেবী টিম দাঁড়িয়ে গেছে। জাতীয়-আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের আহ্বানে এই স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজ করে থাকেন। কিন্তু তখনো কোনো অভিন্ন প্ল্যাটফর্ম নেই, নেই টিমের একক কোনো নাম। এই ভাবনা থেকেই মনে হলো, একটি সংগঠন করা দরকার। নাম ঠিক হলো ২৪ এশিয়া। দিনের ২৪ ঘণ্টার সর্বোচ্চ কার্যকর ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, হাতে-কলমে অভিবাসীদের সেটাই শেখানো হবে। আর কেবল বাংলাদেশি

স্বেচ্ছাসেবীর পুরস্কার হাতে নাজমুল খান
ছবি: সংগৃহীত

অভিবাসী শ্রমিক নয়, এশিয়ার অন্যান্য দেশের যাঁরা এ দেশে থাকেন, তাঁরাও এর অংশ হবেন। ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে
২৪ এশিয়া।

যার যার অবস্থান অনুযায়ী পড়াশোনা করে কীভাবে নিজেকে আরও যোগ্য করে তোলা যায়, সেই কাজটিই করে থাকে ২৪ এশিয়া। সময়ের অভাব আর অর্থাভাব, এই দুটো কারণে কাজের ফাঁকে পড়াশোনা ও ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে পারেন না শ্রমিকেরা। এ জন্য বিনা মূল্যে এসব নিশ্চিত করেন নাজমুল খান।

এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সিঙ্গাপুর প্রেসিডেন্টস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ১১ অক্টোবর। ‘পিপল অব গুড’ শ্রেণিতে স্বর্ণপদক পান নাজমুল। তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেন সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট হালিমা ইয়াকুব।