কেন কেউ কেউ পাশের বাসার আন্টি ও আঙ্কেল হয়ে ওঠেন
এই আন্টি বা আঙ্কেলদের আপনি চেনেন। জীবনে একবার হলেও আপনি তাঁদের ‘ফেস’ করেছেন। তাঁরা আপনার সুখের সময়ে যেমন থাকেন, দুঃখের সময়েও চারপাশে ঘোরেন। তবে সব সময় আপনার আশপাশে থাকলেও তাঁদের যখন যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কথা, তাঁরা তা করেন না। আবার তাঁরা যে নিজের কাজটা করছেন না, সেটা আপনি সাদা চোখে বুঝতেও পারবেন না। কখনো মনে হবে তাঁরা আপনার খুবই আপনজন, কিন্তু বেশির ভাগ সময় সেটা ঠিক নয়। এই আন্টি বা আঙ্কেলরা আপনার সামনে যেটা বলছেন, সে সময়ে তাঁদের মন বলছে অন্য কথা। তাই ‘মাইন্ড রিডার’ না হয়েও চোখ–কান খোলা রেখে আপনি তাঁদের চিনে নিতে পারেন। কারণ, তাঁরা ‘পাশের বাসার আন্টি/ আঙ্কেল’। তাঁদের যেমন আপনার দরকার, তাঁদের এড়িয়ে চলাও সমান দরকার।
এই আন্টি ও আঙ্কেলরা আদতে যেমন
আপনি চান বা না চান, শিশুকাল থেকে এই আন্টিরা আপনার পিছু নেবেন। জীবনের একেক পর্যায়ে এই আন্টিদের দেখা পাবেন একেকভাবে। আপনার ছোটবেলায় তাঁরা স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে অকারণে বেছে বেছে কম নম্বর পাওয়া ছেলে–মেয়েদের সঙ্গে নিজের সন্তানের তুলনা করবেন। আপনার মা–বাবার সামনে এমনভাবে আন্টিরা তাঁদের সন্তানের প্রশংসা করবেন, যেন বাড়ি ফিরতে ফিরতেই আপনার পিঠে দুই–চার ঘা পড়ে। পড়বেও। মায়েরা এই আন্টিদের সন্তানের গুণপনার কথা শুনে আপনার সঙ্গে তুলনা টানবেন কথায় কথায়। অথচ তাঁরা কেউই জানবেন না, স্কুলের সদর দরজা দিয়ে সন্তান ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পর কে কেমন, সেটা আন্টিদের চেয়ে এই শিশুরাই ভালো জানে। হয়তো ওরাই একজন আরেকজনের ভালো বন্ধু। ভালো সহপাঠী। একজন ক্লাসের নোট নিতে না পারলে, অন্যজন তাকে সাহায্য করে। টিফিন ভাগাভাগি করে খায়। স্কুলের সদর দরজায় অপেক্ষায় থাকা এই আন্টিরা জানতেও পারেন না তাঁদের ‘ভালো ছেলে’ আদতে অতটা ভালোও নয়। আগের দিনই হয়তো সে স্কুলের পাঁচিল টপকে দুই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরে এসেছে বাইরে।
এটা তো গেল স্কুল–কলেজের আন্টিদের কথা। যাঁদের সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট সময়ই দেখা হয়। স্কুল শুরু বা শেষ হওয়া ছাড়া বড়জোর কোনো বন্ধুর জন্মদিনের দাওয়াতে। তবে রোজ রোজ বাড়ির পাশে যে আন্টি ওত পেতে থাকেন, তিনি যেন আরও অদ্ভুত, আরও গায়েপড়া। আপনি কখন পড়ছেন, কখন খাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে ঘুরছেন—সবই পাশের বাড়ির আন্টির নখদর্পণে থাকে। অথচ নিজের সন্তান নিয়ে তাঁর খুব একটা মাথাব্যথা নেই। আপনি কোনো বড় সাফল্য পেলেও এই আন্টিদের কাছে তা নস্যি। কেউ হয়তো বলল, ‘আন্টি, আমি গুগলে চাকরি পেয়েছি।’ এই আন্টিরা উত্তরে বলবেন, ‘গুগলে! কেন, বিসিএস হয়নি?’
অনেক সময় এই আন্টিরা বাসার দোরঘণ্টি বাজাবেন কোনো গোপন কেচ্ছা বলতে। ঢুকেই এমন তাড়াহুড়া করবেন, যেন তাঁর বসার সময় নেই। গোটা সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো পাড়ার গল্প করে ফেরার পর ঘড়িতে তাকিয়ে দেখবেন, দুই ঘণ্টা কেটে গেছে। এই আন্টিদের চোখ ঘরের মধ্যে যতক্ষণ থাকে, তার চেয়ে বাইরেই বেশি ঘোরাফেরা করে। পাড়ার কোন ছেলে কখন বাড়ি ফিরছে, কোন মেয়ে কার সঙ্গে হেসে কথা বলছে—এসবই যেন তাঁদের ঘণ্টা–মিনিট ধরে মুখস্থ। অথচ এই আন্টির নিজের ছেলেই হয়তো দুদিন ধরে বাড়ি ফিরছে না, সেটা নিয়ে তাঁর বিশেষ চিন্তাও নেই। পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরির জন্য আপনার নিজের তাগাদা না থাকলেও এই আন্টিরা আপনাকে রোজ সেই তাড়া দেবেন। সপ্তাহে হয়তো চার দিনই আপনাকে দেখলে জিজ্ঞেস করবেন, ‘এখনো চাকরি পাওনি? আমার ভাইঝি তো পাস করার আগেই কোম্পানিগুলো লাইন দিয়ে অফার লেটার পাঠাচ্ছে। কোনটায় জয়েন করবে, বুঝতেই পারছে না।’
কোনোরকমে একটা চাকরি পেয়েছেন তো ব্যাস, এবার আন্টির ঘুম হবে না আপনার বিয়ের চিন্তায়। এত বয়স হয়ে যাচ্ছে, এরপর তো পাত্র–পাত্রী মিলবে না! এই আন্টিরা দেখা দেবেন পাশের বাড়ি ছাড়িয়ে শপিং মল, রেস্তোরাঁ, বিয়েবাড়ি, পারিবারিক গেট টুগেদারের মতো জায়গায়ও। এভাবে বিয়ের পর সন্তান নেওয়া, বেড়াতে যাওয়া, সাজপোশাক—সবকিছু নিয়েই এই আন্টিদের মতামত থাকে। তিনি হয়তো অনেক সময় বুঝতেও পারেন না যে ভুল করছেন।
এই পাশের বাসার আন্টি মূলত একটি রূপক। যেখানে লিঙ্গভিত্তিক পরিচিতি ছাপিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন আরও বিশেষ কিছু। এমন পুরুষও কিন্তু আমাদের সমাজে আছেন, যাঁরা অন্যের নানা বয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে নানা রকম মন্তব্য করেন। গলির মোড়ের চায়ের দোকান থেকে সবজি বাজার, সবখানেই এমন পুরুষের দেখা মেলে। কোনো তরুণ হয়তো স্টাইল করে চুল কাটালে তাঁরা সমালোচনা করবেন, কোনো তরুণী অবেলায় বাইরে গেলে তাঁদের চক্ষুশূল হবে।
আবার প্রতিবেশীদের মধ্যে এমন আন্টিরাও আছেন, যাঁরা পরিবারের মতোই আপন হয়ে ওঠেন। যাঁদের চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। নিজের বা পরিবারের একান্ত বিষয় এই আন্টিদের কাছে শেয়ার করে অনেকটা প্রশান্তিও মেলে।
কেন এমন হয়
কিছু মানুষ কেন এমন হয়? জানতে চেয়েছিলাম সমাজবিজ্ঞানী সুলতানা মোস্তফা খানমের কাছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সুপারনিউমারারি অধ্যাপক বলেন, ‘পাশের বাসার আন্টি ধারণাটি এমন এক আচরণ, যা নারী–পুরুষ উভয়ের মধ্যেই দেখা যায়। আমি এমন একজন আঙ্কেলকে চিনি, যিনি পরচর্চা করতে ভালোবাসেন। যেসব মানুষের হাতে অলস সময় থাকে, তাঁদের কেউ কেউ সাধারণত পাশের বাসার আন্টি হয়ে ওঠেন। তাঁরা অন্যের ভালো কাজের মধ্যেও একটা “কিন্তু” দেখতে পান। তবে অনেকে এমন কাজ করেন অনেকটা না বুঝেই। স্বাভাবিকভাবেই এই আচরণ প্রত্যাশিত নয়।’
এই সমাজবিজ্ঞানীর মতে, অনেকে যেমন না বুঝে এমন আচরণ করেন, কেউ কেউ আবার হিংসা–বিদ্বেষ কিংবা স্রেফ মজা দেখার জন্যও করেন। আবার কেউ অন্যের বাড়ির হাঁড়ির খবর জানাকে নিজের বিশেষ দক্ষতা মনে করেন। অথচ এটা যে ভুল বা অন্যায়, সেই শিক্ষা তাঁদের শৈশব–কৈশোরে পারিবারিকভাবে পাওয়া জরুরি ছিল। একটা মানুষ কেবল শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকলেই কিন্তু আমরা তাকে পুরোপুরি সুস্থ বলে ধরে নিতে পারি না; সামাজিকভাবে সুস্থ না হলে কাউকে প্রকৃত সুস্থ বলা যায় না। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এ ধরনের আচরণ অগ্রহণযোগ্য। তাই পরিবার থেকে ছোটবেলায় সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের শিক্ষা দেওয়া জরুরি।
পাশের বাসার আন্টি যেমন কৌতূহলি, প্রতিবেশীদের নিয়ে পরচর্চা করতে ভালোবাসেন, আবার একদল আন্টি আছেন, যাঁরা প্রতিবেশীর বিপদে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাই সরলভাবে সব আন্টিকে এই নেতিবাচক চরিত্রের মধ্যে ফেলা ঠিক হবে না বলে মনে করেন সুলতানা মোস্তফা খানম।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মনোবিজ্ঞানী নাদিয়া নাসরিন বলেন, ‘যাঁরা এই পাশের বাসার আন্টি হয়ে ওঠেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো তা বুঝতে পারেন না। অনেকে এই আচরণে অভ্যস্থ হন অন্যকে দেখে দেখে। কেউ আবার ছোটবেলায় এমন আচরণের শিকার হয়ে নিজেই পাশের বাসার আন্টি হয়ে ওঠেন।’
কী করবেন এখন
অন্য পরিবারের হাঁড়ির খবর রাখা এসব মানুষের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কেমন, তা বুঝে আচরণ করা জরুরি। অনেক সময় পাশের বাড়ির আন্টি হয়ে ওঠেন পরিবার বা নিকটাত্মীয়দের কেউ কেউ। তাঁর সঙ্গে যেমন আচরণ করবেন, প্রতিবেশীর সঙ্গে ঠিক তেমন আচরণ করা যাবে না স্বাভাবিকভাবেই। মনোবিজ্ঞানী নাদিয়া নাসরিন মনে করেন, একেকজনের কমিউনিকেশন প্যাটার্ন একেক রকম। পরিবার বা আত্মীয় হলে তাঁর সঙ্গে খোলামেলাভাবেই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। আর সমালোচক যদি আপনার আত্মীয় না হন, তাহলে একটা দেয়াল তুলে দিন। আপনার জীবনে তাঁকে কতটা জায়গা দেবেন, সেটা আপনিই ঠিক করুন। কার কথায় ঠিক কতটা প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, সেটা নিজেই বুঝে ঠিক করুন। একজন আপনার সম্পর্কে কিছু একটা বলার পর আপনি পাল্টা আঘাত দিয়ে জবাব না দিয়ে বরং নিজের অনুভূতিটা অন্যভাবেও তাঁর সামনে উপস্থাপন করতে পারেন। যাঁরা অন্যের বাড়ির খবর নিয়ে এমন সমালোচনায় মেতে থাকেন, তাঁদের পরিবর্তন করা কঠিন। তাই তাঁদের সঙ্গে কথা বলার কৌশলটা নিজেই রপ্ত করে নিন।
একই সঙ্গে যিনি এমন আচরণ করছেন, নিজেকে বদলাতে প্রথমত তাঁর আত্মোপলব্ধি জরুরি। অনেকে বোঝেনই না এই আচরণ ঠিক নয়। তাই কাছের মানুষেরা ওই ব্যক্তিকে সহজভাবে বুঝিয়ে বললেই মঙ্গল। একই সঙ্গে মনোবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে এ ধরনের আচরণ থেকে বের হয়ে আসতে পারেন।