দেশের এই স্থাপত্য আলোকচিত্রীর তোলা অনেক ছবিই হয়তো দেখেছেন, জানেন কি তাঁর সম্পর্কে?
আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত দেশি স্থাপনার সংখ্যা এখন কম নয়। এসব স্থাপনার বেশির ভাগের ছবিই সাধারণ মানুষের চোখের সামনে এসেছে আসিফ সালমান–এর কল্যাণে। পেশাদার স্থাপত্য আলোকচিত্রী হিসেবে গত ছয় বছরে পাঁচ শতাধিক প্রকল্পে কাজ করেছেন এই তরুণ। স্থাপত্য বিষয়ে পড়তে এসে তিনি কীভাবে স্থাপত্য আলোকচিত্রী হলেন, সে গল্প শুনলেন সজীব মিয়া
‘ছোটবেলায় স্থপতিই হতে চেয়েছি।’
এই স্বপ্নের পথে হাঁটতে গিয়েই স্থাপত্য আলোকচিত্রের জগতে পা রাখেন আসিফ সালমান। শুরুতে যা ছিল শখের কাজ, পরে সেটাকেই বেছে নিলেন পেশা হিসেবে। আসিফের এই পথচলার গল্প শুনছিলাম ঢাকার নিকেতনে তাঁর বাসায় বসে।
উচ্চমাধ্যমিক শেষে ঢাকার আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হন আসিফ। ২০১১ সালে ক্লাস করতে করতে বুঝলেন, স্থাপত্য এমন এক বিষয়, যেখানে বৈচিত্র্যের শেষ নেই। একটি স্থাপনা কেবল ইট–বালু–সিমেন্টের কাঠামো নয়, বরং একটি ভাষা।
স্কুল-কলেজে নানা সৃজনশীল কাজে যুক্ত ছিলেন আসিফ। লিটলম্যাগ বের করতেন, বিজ্ঞান মেলা করতেন। সেই চর্চার ধারায় স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে উঠে তাঁর মনে হলো, স্থাপত্যের ভাষাকেও লিটলম্যাগে প্রকাশ করবেন। এ কাজে পাশে পেলেন বাল্যবন্ধু সাজেদুল ইসলাম শুভ্রকে। দুজনেরই বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা যশোরে। সাজেদুলও তখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য নিয়ে পড়ছেন।
সাজেদুল লেখালেখির কাজটুকু করলেন, আসিফ তুললেন নানা স্থাপনার ছবি। এভাবে দুই বন্ধু মিলে বানিয়ে ফেললেন ম্যাগাজিনের ডামি। কিন্তু ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে দরকার টাকা আর সহযোগিতা। স্থপতিদের কাছে যেতে শুরু করলেন দুই বন্ধু। একদিন গেলেন স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশের কাছেও। তিনিই পরে স্থাপত্যবিষয়ক ম্যাগাজিনে কাজের সুযোগ করে দেন। স্বনামধন্য এই স্থপতির সম্পাদনায় নতুন ম্যাগাজিনের নাম হয় ডট।
২০১৬ সালে স্নাতক শেষ করে এ কাজেই মুস্তাফা খালিদ পলাশের প্রতিষ্ঠান ‘ভিসতারা আর্কিটেক্টস’–এ যোগ দেন আসিফ সালমান। চলতে থাকে নিয়মিতভাবে স্থাপত্যের ছবি তোলা।
ছবিই তুলবেন আসিফ
২০১৯ সাল আসিফের জন্য বাঁকবদলের বছর। তখন চাকরি ছেড়ে নিজের মতো ছবি তোলা, স্টুডিও খুলে স্থাপত্যবিষয়ক অ্যানিমেশন তৈরির কাজ করছেন। বললেন, ‘২০১৯ সালের দুটি কাজ আর্কিটেকচারাল ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নিতে আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছে।’
কাজ দুটি কী? একটি সাতক্ষীরার ‘ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল’। এই প্রকল্পের নকশা করেছেন স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। সে বছর হাসপাতালের ডকুমেন্টেশনের জন্য ছবি তুলতে দেশে এসেছিলেন খ্যাতিমান সুইস-ফরাসি স্থাপত্য আলোকচিত্রী হেলেন বিন। খবরটা জেনে তরুণ আসিফ সালমান চেষ্টা করেন তাঁর সঙ্গে দেখা করার। কিন্তু দেখা হয় না।
তবে হেলেন চলে যাওয়ার পরপরই আসিফও গিয়ে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল প্রকল্পের ছবি তোলেন। বাছাই ছবি নিজের গরজেই পাঠান স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরীকে। দিন যায়, মাস যায় স্থপতির পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পান না আসিফ। ভাবেন, ছবিগুলো হয়তো পছন্দই করেননি তিনি।
‘আমাকে অবাক করে দিয়ে মাস ছয়েক পর কাশেফ স্যার উত্তর দিলেন। ছবিগুলোর জন্য বাহবা দিলেন।’ বলছিলেন আসিফ।
সেই বাহবা যে কথার কথা ছিল না, আসিফ তা বুঝলেন তাঁর তোলা ছবিগুলো নানা প্রকাশনা ও প্রচারণায় দেখতে পেয়ে। আত্মবিশ্বাস পেলেন স্থাপত্য আলোকচিত্রকে পেশা হিসেবে নেওয়ার।
আসিফের ক্যামেরা চলছে
২০১৯ সালেই স্থপতি মেরিনা তাবাশ্যুম শুরু করেন ‘খুদি বাড়ি’ প্রকল্প। এই প্রকল্পের সঙ্গেও কাজের সুযোগ পান আসিফ সালমান। এই কাজ করতে করতেই পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে অনেক স্থপতিই খুঁজতে শুরু করেছেন আফিসকে। ফলে করোনাকালে দেশের বিভিন্ন স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের হয়ে ছবি তুলতে থাকেন তিনি।
২০২১ সালে পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যকলার জন্য রয়্যাল ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের (রিবা) দেওয়া বিশ্বের সেরা ভবনের পুরস্কার পায় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। বৈশ্বিক স্থাপত্য আলোকচিত্রে পরিচিতি পান আসিফ সালমান।
এরপর ২০২৩ সালে জার্মানির মিউনিখে পিনাকোথেক ডার মডার্ন মিউজিয়ামে মেরিনা তাবাশ্যুমের প্রথম একক প্রদর্শনী ‘মেরিনা তাবাশ্যুম আর্কিটেক্টস: ইন বাংলাদেশ’-এ ব্যবহৃত ছবির বড় অংশই ছিল আসিফ সালমানের তোলা। একই সঙ্গে মেরিনা তাবাশ্যুমের ২৮ বছরের সৃষ্টিশীল যাত্রা নিয়ে প্রকাশিত বইয়েও স্থান পায় তাঁর ছবি। সেই প্রদর্শনীতে উপস্থিত থেকে শত শত দর্শনার্থীর সঙ্গে কথা বলা, বাংলাদেশের স্থাপত্য নিয়ে তাঁদের কৌতূহলের জবাব দেওয়া—সব মিলিয়ে অভিজ্ঞতাটি ছিল আসিফের জন্য বিশেষ।
পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে গত ছয় বছরে পাঁচ শতাধিক প্রকল্পে কাজ করেছেন আসিফ সালমান। আবাসিক ভবন, কারখানা, হাসপাতাল, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—স্থাপনার নানা ধরনই তাঁর ক্যামেরায় এসেছে। আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার, টাইম সাময়িকীর স্থাপত্য স্বীকৃতিসহ দেশের যেসব স্থাপত্য পুরস্কার জিতেছে, তার বেশির ভাগের চাক্ষুষ নথি তৈরি হয়েছে আসিফের ছবিতে।
নিজের কাজ দিয়েই বিশ্বের খ্যাতিমান স্থপতি ও স্থাপত্য আলোকচিত্রীদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন, পাচ্ছেন তাঁদের বাহবাও। তাই তো আসিফ সালমান বলেন, ‘যত দিন আনন্দ পাব, ছবিই তুলে যাব।’