সেরা কলেজের সেরা শিক্ষার্থীরা এখন কোথায়

রাজশাহী কলেজ
ছবি: প্রথম আলো

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর ‘পারফরম্যান্স র‌্যাঙ্কিং’ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে। করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০১৮ সালের ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে। টানা চারবারই রাজশাহী কলেজ দেশসেরার স্বীকৃতি পেয়েছে। বর্তমানে সেরা কলেজের সেরা শিক্ষার্থীরা কে কোথায়, জানতে চেয়েছিলাম আমরা। বাংলা, পদার্থবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, রসায়ন, প্রাণিবিজ্ঞান, ইংরেজি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৩৫ শিক্ষার্থীর অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছেন এই প্রতিবেদক। এই শিক্ষার্থীরা ২০১২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম হয়েছেন। কেউ কেউ সামগ্রিক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলেও হয়েছিলেন প্রথম।

ছড়িয়ে গেছেন নানা প্রান্তে

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ৩৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিসিএস সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন একজন, সরকারি হাইস্কুলে চাকরি করছেন একজন। এ ছাড়া ব্যাংকে চাকরি করছেন একজন, অন্যান্য সরকারি চাকরিতে তিনজন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পাঁচজন, বেসরকারি হাইস্কুলে ছয়জন, বেসরকারি কলেজে চারজন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে কাজ করছেন একজন। গৃহিণী দুজন। একজনের নিজস্ব ব্যবসা আছে। আটজন চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একজন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আর একজন এখনো পড়ালেখা করছেন। মুঠোফোনে কথা হলো এই তরুণদের কয়েকজনের সঙ্গে।

কাকলী রানী ২০১৭ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। কলেজে নিজ বিভাগে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় তিনি প্রথম হয়েছিলেন। সিজিপিএ ছিল ৩ দশমিক ৬৯। স্নাতকোত্তরে হয়েছিলেন তৃতীয়। ৪০তম বিসিএসে তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।

কাকলী রানী
ছবি: সংগৃহীত

কাকলীর বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার পালপাড়া গ্রামে। কলেজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘আমাদের কলেজে একজন শিক্ষার্থীকে শুধু যে ভালো ফলের জন্য পড়ানো হয়, তা নয়; সব মিলিয়ে শিক্ষকেরা একজন ভালো মানুষ হওয়ার দীক্ষা দেন। অনেক সময় শিক্ষকদের অফিসে গিয়ে দেখেছি, তাঁরা নাশতা করছেন। তাই বলে বের করে দেননি, বলেননি পরে আসো। বরং আমাকেও তাঁদের সঙ্গে খেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই স্নেহ সব সময় পেয়েছি।’ একই বিভাগ থেকে হাবিবা খাতুন ২০১৮ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। স্নাতক (সম্মান) এর ফলে তিনি কলেজেও প্রথম হয়েছিলেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলে প্রথম হয়েছেন, ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। স্নাতকোত্তর পরীক্ষার র‌্যাঙ্কিং তিনি জানতে পারেননি। তবে তাঁর সিজিপিএ ছিল ৪ এর মধ্যে ৩ দশমিক ৯২। স্নাতকে ৩ দশমিক ৮১। স্নাতকোত্তরের ফল বের হওয়ার আগেই তিনি রাজশাহী নগরের মুসলিম হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এখন চাকরির পাশাপাশি অন্য পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হাবিবার বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিয়ান গ্রামে।

রাশেদুল ইসলাম রাজশাহী কলেজ থেকে ২০১৮ সালে হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। বিভাগের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। তাঁর সিজিপিএ ছিল ৩ দশমিক ৬৩। নওগাঁর এই তরুণ এখন একটি সফটওয়্যার কোম্পানির নির্বাহী হিসেবে কাজ করছেন। ৪১তম ও ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে টিকতে পারেননি। তিতাস গ্যাস কোম্পানির হিসাব শাখায় পরীক্ষা দিয়েছেন। লিখিত পরীক্ষায় টিকেছেন। এখন মৌখিক পরীক্ষার অপেক্ষায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদেও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন তিনি।

সংসার এবং ক্যারিয়ার

লুৎফুন্নাহার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। এ পরীক্ষায় তিনি বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায়। এখন তিনি গৃহিণী। সাত মাস বয়সী এক সন্তানের জননী। লুৎফুন্নাহার বললেন, ‘বাচ্চা হওয়ার আগে কয়েকটি চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম। হয়নি। পরে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পর মনে হচ্ছে, একজন শিক্ষিত মা হিসেবে আমি আমার সন্তানকে মানুষ করতে চাই। এটাও বড় ব্যাপার। সবাই চাকরি করবে, তা তো নয়।’

কথা হলো সামিনা তাসনিম নামের আরেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। শুধু রাজশাহী কলেজে নয়, পদার্থবিজ্ঞানের এই ছাত্রী ২০১৭ সালে পুরো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌথভাবে সেরা হয়েছিলেন। সিজিপিএ ছিল ৪-এ ৪। সামিনার বাড়ি রাজশাহী নগরের সাগরপাড়া এলাকায়। এসএসসি ও এইচএসসিতেও সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘ইচ্ছা ছিল মেডিকেল কলেজে পড়ব। চান্স না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত রাজশাহী কলেজেœস্নাতক (সম্মান) পড়তে হয়েছে।’ কিন্তু এখানেই নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। পড়ালেখা শেষে গ্রামীণ ব্যাংকের শিক্ষানবিশ অফিসার পদে চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু পরে মনে হয়েছে, মেয়েদের জন্য কাজটা খুব চ্যালেঞ্জিং। তাই আর যোগ দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে বিয়ে করেছেন। সামিনার স্বামী একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন, পোস্টিং ময়মনসিংহে। চার মাস ধরে ময়মনসিংহেই আছেন সামিনা। বাড়িতে বসে তিনি বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

রাজশাহী কলেজ কেন সেরা

ইংরেজি বিভাগে স্নাতকোত্তর শেষ করে বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকে ‘ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার’ হিসেবে কর্মরত মো. আবদুল্লাহ আল নোমান। নোমান মনে করেন, রাজশাহী কলেজের সেরা হওয়ার পেছনে এখানকার সহশিক্ষা কার্যক্রমেরও বড় অবদান আছে। বলছিলেন, ‘আমি আমার পড়াশোনার পাশাপাশি কলেজের বিভিন্ন সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকার সুযোগ পেয়েছি; যেমন বিতর্ক, ছায়া জাতিসংঘ, ইয়ুথ লিডারশিপ ট্রেনিং, স্টুডেন্ট কমিউনিটি পুলিশিংসহ বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক ও জ্ঞানচর্চামূলক সংগঠনে কাজের মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস পেয়েছি। চাকরি শুরু করার পরও এ অভিজ্ঞতাগুলো খুব কাজে লাগছে।’

আরেক ব্যাংক কর্মকর্তা, পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো. শফিক কামালও বললেন সহশিক্ষা কার্যক্রমের সুফলের কথা। বলছিলেন, ‘আমার বিভাগের একটা ক্লাবের কথাই বলি—স্ট্যাটিসটিক্যাল পাইওনিয়ার ক্লাব। ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ক্লাবটি যাত্রা শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল একাডেমিক পড়ালেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছু দক্ষতা গড়ে তোলা। ক্লাবটি প্রতিবছর বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে। ক্লাবের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ নানা পদে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমেই কিন্তু ওরা দায়িত্বশীল হতে শেখে। একটা প্রোগ্রাম সফলভাবে আয়োজন করার জন্য ওরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে। নানা জায়গায় ছোটাছুটি করে, মানুষের সঙ্গে কথা বলে, ওদের কমিউনিকেশনের দক্ষতা তৈরি হয়। ওরা শেখে, কীভাবে অন্যের সামনে নিজেকে মেলে ধরতে হয়। আমি একটা জিনিস বিশ্বাস করি, একজন সাধারণ শিক্ষার্থী আর একজন দায়িত্বশীল শিক্ষার্থীর মধ্যে অনেক পার্থক্য।’

১৮৭৩ সালে মাত্র ছয়জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল রাজশাহী কলেজ। সেই সময় অবিভক্ত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও আসাম, বিহার ও ওডিশার শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজে পড়তে আসতেন। কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল খালেক বলেন, ‘রাজশাহী কলেজ থেকে শিক্ষা অর্জন করে এখানকার কৃতী শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন। আমরা বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪, অর্থাৎ শিক্ষা ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও তাঁরা কার্যকর অবদান রাখবেন।’