ইতিহাস ঘুরে আসুন ভিডিও গেম খেলে

ভিডিও গেম কথাটা শুনলেই একসময় ‘মুরব্বি’রা নাক সিটকাতেন। ‘তরুণ সমাজ উচ্ছন্নে গেল’ বলে একটা হইচই পড়ে যেত। অবশ্য এখনো যে চিত্র পুরোপুরি বদলেছে, তা নয়। তবে ভিডিও গেমের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি খানিকটা হলেও ইতিবাচক হয়েছে। ভিডিও গেম থেকে শেখারও আছে অনেক কিছু! সময়ের উপকরণকে যদি আপনি আপন করে নিতে না পারেন, সেটার ভালো দিকগুলোর চর্চা করতে না পারেন, তাহলে ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ বন্দনা করেই চালিয়ে যেতে হবে বাকি জীবন।

সময়ের এক অনন্য আকর্ষণীয় উদ্ভাবন ভিডিও গেম, শিশুদের বিনোদনের অন্যতম উৎস। অবশ্য ভিডিও গেম ‘খেলোয়াড়’দের এখন আর নির্দিষ্ট বয়সে আটকে রাখা যাচ্ছে না। ইদানীং গেমের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন সব বয়সের মানুষ। জনপ্রিয়তা আর অর্থনৈতিক গুরুত্বে ভিডিও গেম গান ও চলচ্চিত্রের মতো বিনোদনের মাধ্যমকে ছুঁয়ে ফেলেছে। বছরের সেরা ভিডিও গেমগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আয়োজিত ‘দ্য গেম অ্যাওয়ার্ডস ২০২২’ লাইভ দেখেছে ১০ কোটির বেশি দর্শক। বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে সফলতার তুলনায় গেমের শৈল্পিক মূল্য আর সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের আলোচনা হয়নি বললেই চলে। তুলে ধরি কিছু খেলার নমুনা, যা আমাদের ইতিহাস আর সংস্কৃতি-সচেতনতাকে সমৃদ্ধ করতে পারে।

হিরোজ অব সেভেন্টি ওয়ানে উঠে এসেছে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান
ছবি: সংগৃহীত

‘হিরোজ অব ৭১’ মুক্তিযুদ্ধের ওপর বানানো প্রথম ভিডিও গেম। ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বরে গুগল প্লে স্টোরে মুক্তি পায় এই গেম। এই খেলায় কাল্পনিক গেরিলা গ্রুপ শামসু বাহিনীকে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বিভিন্ন ধাপে ধাপে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র চালাতে হয়। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, ভয়াবহতা, গুরুত্ব আর খণ্ডযুদ্ধের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে তরুণেরা। নায়ক চরিত্র জয় বাংলা ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যের দিকে গ্রেনেড নিক্ষেপ করার সময় তরুণেরা একাত্তরের চেতনার একটা খাঁটি উপলব্ধি অনুভব করে। ‘হিরোজ অব ৭১’–এর ব্যাপক সফলতার পর প্লে স্টোরে এর আরও দুটি পর্ব মুক্তি দেয় ‘পোর্টব্লিস গেমস’—‘হিরোজ অব ৭১: রিটেলিয়েশন’ আর ‘মুক্তি ক্যাম্প’।

‘এজ অব এম্পায়ার’ আরেকটি ইতিহাসনির্ভর যুদ্ধভিত্তিক খেলা। এটি প্রথম মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে। খেলার শুরুতে আপনাকে ইতিহাসের পাতা থেকে একটা সভ্যতা বেছে নিতে হবে। এরপর সেই সভ্যতার প্রস্তুরযুগে পদার্পণ করে গুটিপাঁচেক কর্মীকে কাজে লাগিয়ে কাঠ, পাথর, খাদ্য ইত্যাদি সংগ্রহ করে বসতি স্থাপন করতে হবে। ক্রমান্বয়ে সেনাবাহিনী, অট্টালিকা আর নৌবহর উদ্ভাবন করে আপনি সভ্যতার পরবর্তী ধাপে উন্নীত হবেন। এভাবে আপনি প্রস্তরযুগ থেকে শুরু করে রেনেসাঁ সভ্যতা পর্যন্ত গড়তে পারেন। সেই সঙ্গে সেই সময় ব্যবহৃত স্থাপত্য বৈচিত্র্য, অস্ত্র, যন্ত্র, পোশাক, সামরিক প্রথা, শাসন ব্যবস্থা—এসব সম্পর্কে জানতে পারবেন। এই গেমের প্রথম থেকে পঞ্চম সিজন পর্যন্ত আপনি ভাইকিং, রোমান, জাপানি, মঙ্গোলীয়সহ প্রায় ৪০টা সভ্যতার সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন।

গেম খেলা এখন আর নিছক বিনোদন নয়, গেম খেলাকে আপনি পেশা হিসেবেও নিতে পারেন, আয় করতে পারেন লাকো ডলার, সেই সঙ্গে শেখারও শেষ নেই
ছবি: পেক্সেলস ডটকম

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল, যেখানে আইনের শাসন ছিল দুর্বল, রেড ডেড রেডেম্পশন খেলার পটভূমি। এই এলাকাকে তখন বলা হতো ওয়াইল্ড ওয়েস্ট। এই খেলার মাধ্যমে আমরা তৎকালীন মানুষের কুসংস্কার, সেই সময়ে নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি, কাউবয়দের জীবনযাপন আর নেটিভ আমেরিকানদের ওপর শাসন-শোষণের একটা স্পষ্ট ও নিরপেক্ষ চিত্র পাই। এ ছাড়া মার্কিন সেনাবাহিনী আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তুলনায় তৎকালীন বেসরকারি গোয়েন্দা বাহিনী পিঙ্কারটনের বিপুল জনপ্রিয়তা আর কার্যকারিতা শিক্ষামূলকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

এ ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেন্দ্রিক কল অব ডিউটি আর ব্যাটলফিল্ড গেমের সিরিজ, মধ্যযুগের ওপর বানানো ‘কিংডম কাম: ডেলিভারেন্স’থেকেও ইতিহাস আর সভ্যতা নিয়ে শেখার আছে অনেক কিছু। এসব গেম খেলার ভেতর দিয়ে আপনি বই পড়ার চেয়েও ইতিহাসের বেশি কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবেন। কেননা, আপনি যখন গেমটা খেলছেন, তখন আপনি আর বর্তমানে নেই, আপনি ওই সময়েরই অংশ। অনেকটা টাইম ট্রাভেল করে সময়গুলোয় ভ্রমণ করে আসার মতোই একটা চমকপ্রদ ব্যাপার!