দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন, সুন্দর শহরে গেছেন কখনো?

এই শহরে রহিমা বেগমের মতো অনেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী গভীর রাতে ও সকালে সব রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে ঝকঝকে–তকতকে করে ফেলেন
ছবি : প্রথম আলো

‘তিরিশ বছর ধরে আমি রাজশাহী শহরের রাস্তা ঝাড়ু দিই। শুরু করেছিলাম দিনে পঞ্চাশ টাকা হিসেবে। আর এখন মাসে পাই দশ হাজারের বেশি,’ বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই কথাগুলো বললেন রহিমা বেগম। তাঁর সঙ্গে আমার হঠাৎ দেখা। ঘড়িতে তখন রাত প্রায় বারোটা। বাবার সঙ্গে জরুরি ওষুধ কিনে বাসায় ফিরছি। শহরের রাস্তায় লোকজন তেমন নেই। মাঝপথে হঠাৎ বড়সড় এক ঝাড়ু হাতে যাত্রার সঙ্গী হলেন তিনি। আর সেই সুযোগে শোনা হয়ে গেল তাঁর রোজকার ছয় কিলোমিটার রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার গল্প।
কিছুদূর এসে রহিমা বেগম নেমে গেলেন। আর আমার মনের ভেতর গেঁথে দিয়ে গেলেন খানিকটা আক্ষেপ। এই রাজশাহী শহরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কত গর্ব করি। অথচ এর পেছনের মানুষগুলোর সঙ্গে কোনো দিন আলাপই হয়নি। বাকি সময়টুকু বাইরে তাকিয়ে রইলাম আনমনে। দৃষ্টিনন্দন সড়কবাতির আলোতে মোহনীয় হয়ে উঠেছে চারপাশ। সড়কের ধার দিয়ে লাগানো ফুলগাছগুলোও আলো মেখে দ্বিগুণ সুন্দর হয়ে উঠেছে।
শহরের শেষ মাথায় ছিল আমার স্কুল। তবু যাতায়াতে কখনো বিরক্ত হইনি। বেশির ভাগ মানুষ চলাফেরা করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কিংবা রিকশায়। সেসব গাড়িতে শব্দ হয় না, ধোঁয়া হয় না। ডিজেলচালিত যানবাহনের ব্যাপারে কড়াকড়ি রয়েছে। আর জ্যামের তো প্রশ্নই ওঠে না। তাই স্কুলে যাওয়ার পথটা একটু বেশি হলেও ক্লান্তি আসেনি কোনো দিন।

স্কুলের শেষ পরীক্ষার দিন আমাদের অটোরিকশা চালক মামা নদীর ধারের রাস্তা দিয়ে নিয়ে আসতেন। রাজশাহী শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে প্রমত্ত পদ্মা। বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে নির্ভার বোধ করতাম সেদিন। এই শহরের সব বয়সের মানুষেরই অবসর কাটে এই নদীর কাছাকাছি বসে। নির্মল বাতাসে তাঁদের মন প্রশান্ত হয়। নদীর পাড়গুলোতে গড়ে তোলা হয়েছে পরিকল্পিত সব পার্ক। সঙ্গে রয়েছে লালন শাহ্ মুক্তমঞ্চ ও রবীন্দ্র-নজরুল মঞ্চ। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অনেক অনুষ্ঠানই সেসব মঞ্চে হয়। বিকেলে ঘুরতে বেরোনো মানুষগুলো দুদণ্ড বসে হয়তো গান, কবিতা শোনে কিংবা নৃত্যের ছন্দে মেতে ওঠে। বর্ষায় আরও ফুলেফেঁপে ওঠে নদী। কিন্তু শহররক্ষা বাঁধের কারণে বন্যার আশঙ্কা থাকে না।

এই শহর ছেড়ে ঢাকায় যেতে মন কেমন কেমন করে
প্রথম আলোর ফাইল ছবি


কলেজ শেষ করে আমি ঢাকায় পড়তে গেলাম। সবার মুখে রাজশাহীর প্রশংসা শুনে অবাক হলাম। এমন একজনকেও পাইনি যে এই বিষয়ে আমার সঙ্গে তর্ক করেছে। পত্রিকায় পড়েছিলাম, বাতাসে ভাসমান মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কণা দ্রুত কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে আছে রাজশাহী শহর। জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উপাত্তের ভিত্তিতে ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।
তাই আমার রাজশাহী-বিলাসে অবশ্য কারও বাধা দেওয়ার কথাও নয়। এই শহরে রহিমা বেগমের মতো অনেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী গভীর রাতে ও সকালে সব রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে ঝকঝকে–তকতকে করে ফেলেন। পর্যাপ্ত ডাস্টবিন থাকায় ময়লা কেউই তেমন বাইরে ফেলে না। সেসব ডাস্টবিনের ময়লা নিয়ম করে রোজ নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে গিয়ে ফেলা হয়। ফুটপাতগুলো কংক্রিট দিয়ে ঘিরে দেওয়া। আর এত কিছুর সঙ্গে উপরিপাওনা হলো, মূল সড়কের দুই ধারে অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রঙিন দেয়াল। শিল্পীর রংতুলির আঁচড়ে ক্যানভাস হয়ে উঠেছে যেন। সব মিলিয়ে বরেন্দ্র জাদুঘর ছাড়া তেমন কোনো ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান না থাকা সত্ত্বেও সারা দেশ থেকে অনেকেই ঘুরতে আসেন রাজশাহী। যেন রাজশাহী শহর নিজেই একটা দর্শনীয় স্থান।
বর্ণিল রাজশাহীর সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হলো এর গাছপালা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ পুরো শহরেই গাছপালার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। সবুজের সমারোহে চোখজোড়া আরাম পায়। গ্রেটার রোড ধরে যখন যাই, সড়ক বিভাজকের ওপরে লাগানো কাঠগোলাপ গাছের ফুলগুলো আমাকে ভীষণ টানে।
অনেকেই বলেন, রাজশাহীতে শিল্পকারখানা নেই, তাই এত পরিষ্কার। কিন্তু আমি দেখেছি বাংলাদেশে আরও অনেক শহর আছে, যেখানে শিল্পকারখানা নেই, কিন্তু সেগুলো এত পরিপাটি নয়। রাজশাহী শহর শুধু নান্দনিক সড়কবাতি কিংবা নদীর জন্যই সুন্দর নয়, এখানকার সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা ভালো বিধায় হাঁটতে গিয়ে নাকে দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা মারে না, চোখমুখ ধুলোয় জ্বালা করে না, গাড়িঘোড়ার শব্দে মাথাটা ভারী হয়ে আসে না।
রাজশাহীর সৌন্দর্যের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এখানকার মানুষজন। ছোট্ট মফস্‌সল শহরটায় সবার মধ্যে অদ্ভুত এক যোগসূত্র আছে। নিরাপদ পরিবেশ হওয়ায় নির্ভয়ে যেকোনো জায়গায় বসে বন্ধু-পরিজনের সঙ্গে সময় কাটানো যায়। বেলা পড়তে না পড়তেই রাস্তার মোড়গুলো জমে ওঠে। বর্ণালির মোড়ের চায়ের কাপে আলোচনার ঝড় ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সদ্যনির্মিত ওভারপাসের ওপরে বিকেল কাটায় মানুষ। বিমানসড়কে যানবাহন কম চলাচল করায় ধীরে ধীরে মানুষের সমাগম বাড়ে।
অন্যান্য শহরে হয়তো খোলা আকাশের নিচে একদণ্ড দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যায় না। এদিকে রাজশাহী শহরে গল্পে মেতে ওঠার জায়গার অভাব নেই। সম্প্রতি সিঅ্যান্ডবি মোড়ে গেলে মনে হয় যেন আকাশটাই মাটিতে নেমে এসেছে; পথের ধারে বসার প্রশস্ত জায়গা। ওদিকে হাইটেক পার্ক কিংবা সিনেপ্লেক্স চত্বরে গিয়ে দাঁড়ালেই মন হারিয়ে যায়। ইচ্ছা হয় অকারণে দাঁড়িয়ে থাকি আরও কিছুক্ষণ। অনুভব করি, এই তো আমার শহর! কোলাহলমুক্ত, নির্মল বাতাসে ভরপুর, নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ রাজশাহী!
তাই হয়তো রাজশাহী ছেড়ে যাওয়ার সময় ট্রেনে উঠে বসতেই চোখ ছলছল করে। ঢাকায় ব্যস্ত জীবন কাটে। দিন গুনি, কবে ফিরব সেই শহরে, যেখানে কেটেছে আমার শৈশব-কৈশোর। স্মৃতিরা পুরোনো চড়ুইপাখির মতো মনের জানালায় এসে বসে। আর তরুণ ছড়াকার দীপান্ত সরকারের লেখা মাথার মধ্যে গুনগুন করে,
‘আমার যদি থাকত ডানা
উড়েই যেতাম রাজশাহী,
যেই শহরে ছিল আমার
ছেলেবেলার বাদশাহী।’

লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়