‘মা মরার খবরটাও সময়মতো পাই নাই’

গাইবান্ধার নছু মিয়া
ছবি: লেখক

নাম তাঁর নছু মিয়া। বয়স জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘কত আর হবি, ৬০-৬২।’ সাংবাদিক শুনে সম্পূরক আরও কিছু তথ্য দিলেন, ‘বয়স্ক ভাতা দেয় নাই। সহায়-সম্পত্তি কিছু নাই। নদীত চলি গেছে।’

গাইবান্ধা সদরের জগৎরায় গোপালপুর গ্রামে নছু মিয়ার সঙ্গে দেখা গত ১৩ এপ্রিল। তখন শেষ বিকেল। গ্রামের পথ ধরে বাড়ি ফিরছিলেন নছু মিয়া। স্মৃতি হাতড়ে জানালেন, তাঁদের বাড়ি ছিল গাইবান্ধার ফুলছড়ির বালাসি ঘাটের রসুলপুরে। সেখানে থাকতেই তাঁর বাবা মারা যান। নছু মিয়ার বয়স তখন মোটে সাত বছর। ১৩ বছর বয়সে নদীভাঙনের শিকার হলেন। এরপর তাঁরা চার ভাই চার জায়গায় ছিটকে পড়লেন। এতিমের মতো একেকজন একেক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। নছুর আশ্রয় হলো গাইবান্ধা শহরের ডেভিট কোম্পানি পাড়ায় ফুফুর বাড়িতে।

গাইবান্ধা শহরেই একটা টেইলার্সে কাজ শুরু করলেন। কিন্তু ফায়ফরমাশ খাটানো ছাড়া কোনো কাজের ব্যবস্থা তাঁরা করে দেননি। একপর্যায়ে গ্রাম ঘুরে ঘুরে ঝুট কাপড়ে তৈরি শিশুদের জামাকাপড় বিক্রি শুরু করেন। এখনো সেই কাজই করছেন। এ জন্য প্রতিদিন তাঁকে কম করেও ৩০ কিলোমিটারের মতো হাঁটতে হয়। বললেন, ‘২০ বছর আগে শিশুদের জামাকাপড় প্রতি পিছ তিন থেকে চার টাকা করে বিক্রি হইত। এহন ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হইলেও পিছপ্রতি লাভ পাঁচ থেকে সাত টাকা। আমার পুঁজিও কম, মাত্র তিন হাজার।’

নছু মিয়ার কাছে জানতে চাই, তাঁর পরিবারে কে কে আছেন? জানালেন, স্ত্রী, ছেলে আর ছেলের বউ। থাকেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার আরিফ খাঁ বাসুদেবপুরে। নিজেকে ‘ঘরজামাই’ পরিচয় দিয়ে জানালেন, দীর্ঘদিনের কষ্টের উপার্জনে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে শ্যালকের কাছ থেকে ২ শতাংশ জমি কিনেছেন নছু মিয়া। ছেলেকে যেন তাঁর মতো অন্যের জায়গায় থাকতে না হয়। বললেন, ‘একটাই থাকার ঘর। মাঝে পার্টিশন দিয়ে ছেলেসন্তান নিয়া থাকি।’

কৈশোরের নদীভাঙা জীবনের দুঃখ-কষ্টের কথা এখনো ভুলতে পারেননি নছু মিয়া। আরও দগদগে হয়ে আছে মায়ের সঙ্গে আলাদা হয়ে যাওয়ার কষ্ট। তিনি বলছিলেন, ‘ঘরবাড়ি নদীতে যাওয়ার পর মা চইলা যান নানার বাড়ি ময়মনসিংহে। আমরা গেলাম আত্মীয়দের বাড়ি। এরপর আর মার সাথে কোনো দিন দেখা হয় নাই। মা মরার খবরটাও সময়মতো পাই নাই।’

মাকে দেখতে না পাওয়ার দুঃখ নছু মিয়ার এই জীবনে যাবে না।