আমাকে বাসায় ডেকে সবার সামনে প্রেমপত্রটা পড়া শুরু করে দিল

‘ছুটির দিনে’র আহ্বানে ভালোবাসার টক–ঝাল–মিষ্টি গল্প লিখে পাঠিয়েছেন পাঠক। কেউ লিখেছেন দুরন্ত প্রেমের গল্প, কেউবা শুনিয়েছেন দূর থেকে ভালোবেসে যাওয়ার অনুভূতি। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আগেই পড়ুন বাছাই এমনই একটি লেখা।

প্রতীকী ছবি

ক্লাস থ্রির প্রথম দিনই যে মেয়েটার প্রেমে পড়েছিলাম, সেই ইরাবতীর জন্য প্রথম ও শেষ কলম ধরেছিলাম ঠিক ২১ বছর আগে।

ইরাবতী ক্লাসের সবার চেয়ে আলাদা ছিল। ওইটুকু বয়সে এত লম্বা আর ঘন কালো চুল আমি আর কারও মাথায় দেখিনি। তখনকার সময়ে পাঁচগুটি, দাঁড়িয়াবান্ধা আর গোল্লাছুট—এই ছিল আমাদের বিনোদন। আমি ছেলে হয়েও পাঁচগুটি খেলতাম ইরার ক্ষণিকের সঙ্গ পাব বলে। ছেলে হয়ে মেয়েদের খেলা কেন খেলি বলে কত দিন বকা খেয়েছি।

প্রাইমারির গণ্ডিটুকু আমরা একসঙ্গে পড়েছি। শিক্ষাজীবনের বাকিটা পথ ছিল দুজনের দুদিক। আমাদের দুজনের ভালো লাগা আর ভালোবাসাও ছিল দুরকম। জীবনসঙ্গী করে পাব—এ স্বপ্নে বিভোর ছিলাম আমি, আর ইরার ছিল নিখাদ বন্ধুত্বের ভাবনা। মাঝেমধ্যে খুব অবাক লাগে একটা মানুষ সারা জীবনে প্রেমে পড়া ছাড়া বাঁচে কী করে!

তাকে ভালোবাসার কথাটা দীর্ঘ সাত বছর বুকে চেপে রেখেছিলাম। এসএসসি পরীক্ষার মাস দুয়েক আগে আবেগ আর ধরে রাখতে পারিনি। আঁকুপাঁকু মনের কথা লিখে ইরার হাতে চিঠি ধরিয়ে দিলাম। ঠিক যা মনে মনে ভেবেছিলাম হলো উল্টো। আমাকে ওদের বাসায় ডেকে সবার সামনে জীবনের প্রথম প্রেমপত্রটা পড়া শুরু করে দিল ইরা।

আমি খুব লাজুক প্রকৃতির ছিলাম। লজ্জা আর কেমন যেন একটা অস্বস্তিবোধ হতো বলে কোনো দিন ইরার চোখের দিকে তাকাতে পারিনি। এই যে আমার প্রেমপত্র ইরা পাঠ করল, লজ্জায় সেই প্রেমপত্র আমি লিখিনি, লিখেছিল আমার খুব কাছের এক বন্ধু মিসটিয়া।

সেদিন ইরা চিঠি পাঠ করে খুব ঠান্ডা মাথায় আমাকে আসন্ন পরীক্ষায় মনোযোগী হতে পরামর্শ দিল। কিন্তু তার সুপরামর্শে কাজ হলো না। প্রেমহীন জীবনে আমি রসায়নে ফেল করে বসলাম।

আমাদের বাসা ছিল কলেজের ঠিক পেছনে। ক্লাস শেষে ইরা আমাদের বাসায় সামনের দিয়েই ওদের বাসায় যেত। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম কখন ওকে একটু দেখব। বাঁকটুকু পাড়ি দিতে ওর বড়জোর ৩০ সেকেন্ড লাগত। ওই ৩০ সেকেন্ড আমি শুধু দূর থেকে চোখের পলক পড়ার স্মৃতিটুকু বুকের বাঁ পাশে জমা করতাম।

স্পার্টানবার্গের যে বাসায় এখন থাকি, সেই বাসার সামনেও আমাদের কলেজের পেছনের বাসাটার মতো ছোট একটা পথের বাঁক আছে। প্রায়ই বিকেলে ধূমায়িত এক কাপ চা নিয়ে বাসার সামনে লনের পাশে দোলনায় বসি। বুকের কোথাও একটা ব্যথা চিন চিন করে। পথের বাঁকটাতে তাকাতে তাকাতে দুচোখে ক্লান্তি চলে আসে কিন্তু ইরা আর আসে না। আসবেই–বা কীভাবে, আমাদের দূরত্ব যে সাত সমুদ্র তেরো নদী!

আজ বিকেল থেকে তুষার ঝরতে শুরু করেছে। শুভ্র তুষার হাতে ধরলেই গলে যাচ্ছে। আহা, তুষার গলার মতো ইরার মনটা যদি এভাবে আমার জন্য গলে যেত! না, তাই হয় নাকি! সময়ের ব্যবধানে একতরফা বন্ধুত্ব বদলে গেছে যুগপৎ বন্ধুত্বে। আমার যে এখন সত্যিকারের সেই বন্ধু, যা বাল্যকালেই ইরা চেয়েছিল। ইরার ছোট্ট একটা সংসার আছে। আমিও দেবদাস হয়ে যাইনি। আমার সংসারেও মুঠোভরা ভালোবাসা আছে। বন্ধুত্ব যেমন শুধু একজনের জন্য নয়, তেমনি ভালোবাসাও সময়ের স্রোতে এক জায়গায় স্থির থাকে না। সেই ভালোবাসার গল্প নাহয় অন্য কোনো সময়।