আপনি কি ফোন ডায়েটের জন্য প্রস্তুত
আমাদের মস্তিষ্ক স্মার্টফোনের মতো ডিজিটাল ডিভাইস দ্বারা প্রবলভাবে আক্রান্ত। এখন সময়টাই এমন যে আপনি অনেক কিছু ছাড়াই একটা দিন কল্পনা করতে পারবেন; কিন্তু স্মার্টফোন ছাড়া? প্রায় অসম্ভব। স্মার্টফোন আসক্তি রীতিমতো স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আর এর কুফল এককথায় মারাত্মক!
ফোন ডায়েট কী
ফোন ডায়েট বা ডিজিটাল ডায়েট হলো মুঠোফোনের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ রাখা। বিশেষজ্ঞরা ই-মেইল, হোয়্যাসটঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহারের সময়সীমা দিনে এক ঘণ্টার মধ্যে আনার পরামর্শ দিচ্ছেন। আর সপ্তাহে এক দিন স্মার্টফোনকে ছুটিতে পাঠাতেও পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা। ওই দিন কেবল কথা বলা ছাড়া আর কোনো কাজে ফোন ব্যবহার করতে মানা। এটিই স্মার্টফোন ডায়েটের একটি আদর্শ রূপ। যখন আপনি কেবল এক ঘণ্টা ফোন ব্যবহার করবেন, স্বাভাবিকভাবে তখন কেবল অতি প্রয়োজনীয় কাজই সারবেন।
ফোন ডায়েটের প্রধান দুটি শর্ত
২৪ ঘণ্টায় ১ ঘণ্টা ফোন ব্যবহার করা।
সপ্তাহে এক দিন স্মার্টফোনকে ছুটি দেওয়া।
কেন করবেন ফোন ডায়েট
ফোন ডায়েটের ফলে আপনার মনোযোগের স্থায়িত্ব বাড়বে। যেকোনো কাজ সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে করতে পারবেন। ‘ডিসট্রাকশন’ বা মনোযোগ ছুটে যাওয়ার সমস্যা কমবে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা হবে সহজ। ডিজিটাল ডিভাইস বা পর্দা থেকে বিকিরিত নীল আলো কমে যাওয়ার ফলে ঘুমের মান ভালো হবে। নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে উঠতে সুবিধা হবে। রুটিনমাফিক স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করা হবে সহজ।
গবেষণা জানাচ্ছে, অনিয়ন্ত্রিত ফোন স্ক্রলিংয়ের সঙ্গে স্থূলতার সম্পর্ক আছে। কেউ যখন ফোন স্ক্রল করতে করতে খান, তখন তিনি খুব কমই সে খাবার উপভোগ করতে পারেন। তাই বার্গার, পিৎজা বা ফাস্টফুডের মতো খাবারে আগ্রহী হন। ফোন ডায়েটে থাকলে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে আগ্রহী হওয়া সম্ভব। পরিবার ও কাছের মানুষদের সঙ্গে সময় কাটানো যায়। মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি চোখ, মস্তিষ্ক ও হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও ফোন ডায়েট কার্যকর।
গবেষণা জানাচ্ছে, মাত্র ৭২ ঘণ্টা বা ৩ দিন স্মার্টফোন ছাড়া থাকলেই আপনার মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
ফোন ডায়েটের আগে–পরে
গবেষণাটি পরিচালনা করেছে জার্মানির দুটি বিশ্ববিদ্যালয়—হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি ও ইউনিভার্সিটি অব কোলন। গবেষণাটি পরিচালিত হয় ২৫ জন তরুণের ওপর, যাঁদের সবার বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর। গবেষণাটি শুরু করার আগে এই ২৫ তরুণের মস্তিষ্কের এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেজন্যান্স ইমেজিং) করা হয়। এ ছাড়া তাঁদের একটা মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাও নেওয়া হয়।
তারপর তিন দিন এই তরুণদের ফোন ডায়েটে রাখা হয়, অর্থাৎ ৭২ ঘণ্টা তাঁরা স্মার্টফোন ব্যবহার করেননি। স্বাভাবিকভাবে অন্যদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেছেন। আর নিজেদের দৈনন্দিন ও পেশাগত কাজকর্মও করেছেন। ৭২ ঘণ্টা পর আবার তাঁদের এমআরআই টেস্ট ও একই মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষায় এই তরুণদের চালু স্মার্টফোন, বন্ধ স্মার্টফোন, ফুল, প্রকৃতি প্রভৃতির ছবি দেখানো হয়। আর মস্তিষ্ক সেসব ছবি দেখে কীভাবে সাড়া দেয়, তা লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর এই দুই পরীক্ষার পার্থক্য থেকে গ্রহণ করা হয় সিদ্ধান্ত।
এই গবেষণায় যে আশ্চর্য ফলাফল পাওয়া যায়
পরীক্ষায় দেখা যায়, অন্য যেকোনো ধরনের আসক্তি মস্তিষ্কে যেভাবে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে, দিনে ব্যক্তিভেদে তিন–চার ঘণ্টার বেশি স্মার্টফোনের ব্যবহারও একইভাবে ব্যক্তির মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে।
মাত্র তিন দিন স্মার্টফোন ব্যবহার বন্ধ করার ফলে এমআরআই পরীক্ষায় মস্তিষ্কের স্মৃতি সংরক্ষণ, চিন্তা ও সৃজনশীলতার অংশ ভালোভাবে সাড়া দেয়। এর কারণ হলো মানুষ সামাজিক জীবন যাপন করবে, চিন্তা করবে, সমস্যা সমাধান করবে—মানুষের মস্তিষ্ক এভাবেই কাজ করার জন্য উপযোগী। তাই যখন মস্তিষ্ককে যখন কোনো অস্বাস্থ্যকর, চ্যালেঞ্জিং পরিবেশ থেকে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেওয়া হয়, মস্তিষ্ক তখন সেটির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেয় ও ইতিবাচকভাবে সাড়া দেয়।
মানুষ যখন স্মার্টফোন ব্যবহার করে, তখন সে সৃজনশীল চিন্তা করার অবকাশ পায় না। ফলে উদ্ভাবনী ক্ষমতা, যুক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হয়। মস্তিষ্ক দ্রুত বৃদ্ধ হতে থাকে। ফলে কম বয়সেই স্ট্রোক, আলঝেইমারস ডিজিজ, পারকিনসনের মতো সেরিব্রোভাস্কুলার ও নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের ঝুঁকি বাড়ে আশঙ্কাজনক হারে।
স্মার্টফোনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত করার মাধ্যমে আপনি সৃজনশীল কাজে আরও ভালোভাবে মনোনিবেশ করতে পারেন। মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য স্মার্টফোনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত করার কোনো বিকল্প নেই।
সূত্র: মায়ো ক্লিনিক