অফিসের দেয়াল তিনি সাজিয়েছেন শিশুদের ছবি দিয়ে

কাজী ফাহাদুর রহমান অফিসের দেয়ালে শিশুদের ছবি সাঁটিয়ে রেখেছেন

অফিসের দেয়ালে আঠা দিয়ে লাগানো শতাধিক শিশুর ছবি। কেউ হাসছে, কারও চোখ বন্ধ, মিটমিট করে তাকিয়ে আছে কেউ, কেউ আবার মুখ বন্ধ করে হাসছে, কারও মুখে দুষ্টুমির ছাপ। কাজী ফাহাদুর রহমানের অফিসকক্ষের দেয়ালে সাঁটানো এসব ছবি। ঢাকা পশ্চিম (মোহাম্মদপুর) পাসপোর্ট অফিসে কাজ করেন তিনি। কিন্তু শিশুদের ছবি কেন তাঁর অফিসকক্ষের দেয়ালে? আর এসব ছবি তিনি পেলেনই-বা কোথায়? অফিসকক্ষে কাজ করতে করতে নিজেই সেই গল্প শোনালেন ফাহাদুর।

অনেকেই জানেন না, ছয় বছর বা তার কম বয়সী শিশুদের ছবি পাসপোর্ট অফিসে ওঠানো হয় না। অভিভাবকেরাই শিশুদের ছবি তুলিয়ে প্রিন্ট করে নিয়ে আসেন। সেই ছবি স্ক্যান করে পাসপোর্টে জুড়ে দেওয়া হয়। এই ছবিগুলো তারপর আর কোনো কাজে লাগে না। অভিভাবকদের ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগও আর থাকে না কিংবা থাকলেও সেটা বেশ জটিল। ফলে ডাস্টবিনই হয় সেগুলোর গন্তব্য। নিষ্পাপ-সরল এসব মুখের ছবি ডাস্টবিনে ফেলতে ফাহাদের ইচ্ছা করত না। ফলে তাঁর টেবিলে সেগুলো জমা হতে থাকে। পাসপোর্ট অফিসের এই অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক বলেন, ‘এভাবেই অনেক ছবি জড়ো হয়ে যায়। সেগুলো একসময় ড্রয়ারে জড়ো করেছি, সেখান থেকে ঝুড়িতে রেখেছি। কিন্তু শিশুদের দিকে তাকিয়ে ছবিগুলো ফেলতে পারিনি। কী সুন্দর সুন্দর মুখ। আর অভিব্যক্তি। একেকটা ছবি একেক রকম। সর্বশেষ একদিন বাধ্য হয়েই ছবিগুলো ফেলতে গিয়ে কষ্ট হচ্ছিল। তখন মাথায় আসে ছবিগুলো পর্দার সঙ্গে লাগিয়ে রাখি না কেন। এভাবেই এখন কয়েক শ ছবি হয়ে গেছে। এখন ছবি লাগিয়ে রাখাই আমার নেশা।’

আরও পড়ুন

দুটি ছবি দিয়ে শুরু

পাসপোর্ট অফিসের শেষ কাজগুলোর মধ্যে থাকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট, চোখের স্ক্যানিং ও ছবি অ্যাটাচসহ বেশ কিছু কাজ। পরে সিগনেচার নিয়ে ফাইল যাচাই-বাছাই করে ডেলিভারি স্লিপ দিয়ে দেন ফাহাদুর। এসব কাজে ফাহাদুরের রুমে যাঁরাই আসেন, সবারই নজর কাড়ে এসব সংগৃহীত ছবি। একসঙ্গে শতাধিক শিশুর ছবি দেখে সবাই প্রশংসা করেন। তিনি জানালেন, ছবিগুলো সংগ্রহ করার আরও একটি কারণ মানসিক শান্তি। ফাহাদুর বলেন, ‘সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত আমাদের কাজ। আমাদের শিডিউলটা একটু অন্য রকম। কাজে অনেক চাপ থাকে। এই ছবিগুলো দেখলে একটু রিলাক্স পাই, কাজে অন্য রকম একটা শান্তি আসে। ছবিগুলোর পাশেই বসার জায়গা। লক্ষ করে দেখেছি, যাঁরা কাজে আসেন, সবাই ছবিগুলোর মধ্যে হারিয়ে যান। কেউ নিজেদের সন্তান বা প্রিয়জনের সঙ্গে মিল খুঁজে পান। সব মিলিয়ে ছবিকে ঘিরে তৈরি হওয়া পরিবেশটা মন ভালো রাখে।’

প্রতিদিন ফাহাদুরের কাছে কাজে আসা মানুষেরা প্রশ্ন করেন, ছবিগুলো এভাবে লাগানো কেন? ফাহাদুর বলেন, ‘আমার স্যাররাও ছবিগুলোর প্রশংসা করেন। তাঁরা বলে দিয়েছেন, কেউ জিজ্ঞাসা করলে যেন বলি, ছয় বছরের নিচের বাচ্চাদের এমন ছবিই লাগে। এর মধ্যে সচেতনতাও হয়। অনেকে ছবি দেখে এভাবেই ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অনুমোদিত সিস্টেমে শিশুদের ছবি তুলে নিয়ে আসেন। কারণ, বাচ্চাদের ছবি তোলার এটাই নিয়ম। ব্যাকগ্রাউন্ড সাদা, কান দুটো দেখা যাবে, মুখ বন্ধ। বাচ্চাদের কেমন ছবি লাগবে, কেউ জানতে চাইলে অন্য সহকর্মীরা এখন আামার এখানে পাঠিয়ে দেন।’

আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে ছবিগুলো স্ট্যাপল করে জানালার পর্দার সঙ্গে লাগিয়ে রাখতেন ফাহাদুর
ছবি: প্রথম আলো

২০১৭ সালে বিয়ে করেন ফাহাদুর রহমান। পরে তাঁদের একটি বাচ্চা নষ্ট (মিসক্যারিজ) হয়। অনেকেই তখন বলেছিলেন, তাঁরা আর কখনোই সন্তানের মুখ দেখবেন না। ফাহাদুর বলেন, ‘তখন আমার কষ্ট হতো। এসব চিন্তায় আমাদের মনের অবস্থা ভালো ছিল না। শৈশব থেকেই আমি শিশুদের অনেক পছন্দ করতাম। এসবের মধ্যে বাচ্চাদের ছবিগুলো দেখে ভালো লাগত। সেই ভালোবাসা থেকেই ছবিগুলো বারবার ফেলে দেওয়ার কথা ভেবেও ফেলা হতো না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু ফেলে দিয়েও আবার সংগ্রহ করেছি।’ এর শুরুটা হয় আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে। দুটি ছবি দিয়ে শুরুটা হয়েছিল। সবাই যখন অফিস থেকে চলে যায়, তখন ছবিগুলো স্ট্যাপল করে জানালার পর্দার সঙ্গে লাগিয়ে রাখতেন ফাহাদুর। গত চার বছর বছরে তিন শয়ের বেশি শিশুর ছবি সংগ্রহ করেছেন। প্রতিদিন অফিসে এসে এখন সবার আগে শিশুদের ছবি দেখা অভ্যাস হয়ে গেছে। ফাহাদুর বলেন, ‘প্রতিটা শিশুর ছবিই আমার কাছে আপন। পরে আমি বাবা হয়েছি। প্রতিটি শিশুকে মনে হয় সন্তানের মতো।’