এক পায়ে নেচে নতুন কুঁড়ির সেরা দশে জায়গা করে নিয়েছে নওরিন

জন্ম থেকেই বাঁ পা নেই। কখনো ক্রাচে ভর করে, কখনো এক পায়েই লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটাচলা। সেই এক পায়ে নেচেই এবার নতুন কুঁড়ির সাধারণ নৃত্য শাখার ‘ক’ গ্রুপে সেরা দশে জায়গা করে নিয়েছে নওরিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার নাচের ভিডিও দেখছে হাজারো মানুষ। সুনামগঞ্জের অদম্য এই শিশুর গল্প শোনাচ্ছেন খলিল রহমান

এক পায়ে নেচে নতুন কুঁড়ির জাতীয় মঞ্চে এসেছে নওরিনছবি: পরিবারের সৌজন্যে

একটাই পা। সেই পায়ে ছোট্ট নওরিন যখন মঞ্চজুড়ে নাচে, এপাশ থেকে ওপাশে ছুটে যায়, মায়ের বড় ভয় করে। যদি ছিটকে পড়ে, যদি কোনো অঘটন ঘটে। কিন্তু এখনো কোনো অঘটন তাকে স্পর্শ করেনি। অদম্য ইচ্ছা আর স্বপ্ন দেখার সাহস যেন পুরো মঞ্চটাই নওরিনের নিয়ন্ত্রণে এনে দিয়েছে।

মেয়েটা এভাবে এক পায়ে মঞ্চে নাচবে, সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে, মানুষ তাকে চিনবে, সবাই উৎসাহ দেবে, এমনটা কখনো ভাবেননি মা আছমা বেগম। তবে নওরিনের মনে মনে সেই ইচ্ছা ছিল। তাই মুঠোফোন দেখে দেখে সে নাচ শিখেছে। তবে সেটা ছিল নিতান্তই শখের শেখা। কিন্তু শহরের একটি আয়োজনে এক তরুণ নৃত্য প্রশিক্ষকের চোখে পড়ে তার নাচ।

হাসিমুখে মেয়ের শুরুর দিকের গল্পটা যখন বলছিলেন আছমা বেগম, তখন পাশে মেয়ে নুরফিজা হক নওরিন আর সেই নৃত্য প্রশিক্ষক দৃষ্টি তালুকদার।

২২ অক্টোবর রাত আটটার দিকে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের শান্তিবাগ রোডে নওরিনদের বাসায় যখন পৌঁছাই, তখন দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসছিল গানের আওয়াজ। নওরিনের প্রশিক্ষণ চলছে। বিকেলেই বার্তা পেয়েছেন, শুক্রবার নতুন কুঁড়ির চূড়ান্ত পর্ব শুরু হচ্ছে। তাই প্রস্তুতি চলছে। এক পায়ে নেচে সাধারণ নৃত্য ‘ক’ গ্রুপে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায় পার হয়ে জাতীয় পর্যায়ে সেরা দশে স্থান করে নিয়েছে নওরিন। ১০ জনের মধ্যে পেয়েছে সর্বোচ্চ নম্বর। এখন সেরা তিনে থাকার লড়াই। বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকায় রওনা হবে। ২৪ থেকে ২৯ অক্টোবর ঢাকায় চূড়ান্ত পর্বের প্রতিযোগিতা।

কখনো ক্রাচে ভর করে, কখনো এক পায়েই লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটাচলা করে নওরিন
ছবি: পরিবারের সৌজন্যে

মেয়ের প্রশিক্ষণের মধ্যেই মা আছমা বেগম আর প্রশিক্ষক দৃষ্টি তালুকদারের সঙ্গে আলাপ শুরু করি। আছমা বেগম যখন মেয়ের জন্মের সময়ের কথা বলছিলেন, তখন তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন, আবার যখন মেয়ের সাফল্যের কথা শোনান, তখন তাঁর চোখেমুখে আনন্দ, অন্য রকম ভালো লাগা। মায়ের হাসিমুখ দেখে মেয়ে নওরিনের মুখেও ফুটে ওঠে হাসির রেখা।

ওয়ান লেগ, ওয়ান লেগ

অস্ত্রোপচারের টেবিলে পৃথিবীর আলো দেখে নওরিন। মুহূর্তে দূর হয়ে যায় আছমা বেগমের সব কষ্ট। এর মধ্যে পাশে কেউ একজন বলে ওঠেন, ‘ওয়ান লেগ, ওয়ান লেগ।’ তখনো কিছু বুঝে উঠতে পারেননি আছমা। শুধু জানতে চান, সন্তান কেমন আছে। উত্তর পান, ‘ভালো আছে।’ এতেই তিনি খুশি। একপর্যায়ে স্বজনেরা জানান, নবজাতকের একটি পা নেই। তাৎক্ষণিক মন খারাপ হলেও বেশিক্ষণ সেটা স্থায়ী হয়নি। মায়ের মন, সন্তানের জন্য কতক্ষণ খারাপ থাকে।

জন্ম থেকেই বাঁ পা নেই। এক পা দিয়েই লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটাচলা করে। খেলাধুলা করে। কখনো ক্রাচ ব্যবহার করে। আছমা বেগম সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সাক্তারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। সেই স্কুলেই পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে নওরিন। মায়ের সঙ্গেই স্কুলে যাতায়াত করে। পড়াশোনায়ও নওরিন ভালো, ক্লাসে রোল এক। নৃত্যের পাশাপাশি আবৃত্তি, আঁকাআঁকিও করে।

নওরিন নৃত্যচর্চা শুরু করেছে খুব বেশি দিন হয়নি। শুরুতে তার কোনো নৃত্য শিক্ষক ছিল না, মুঠোফোনে দেখে দেখেই সে শিখেছে। গত বছর স্কুলের হয়ে উপজেলা পর্যায়ের একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে মায়ের সঙ্গে জেলা শহরে আসে। অনুষ্ঠান শেষে এক তরুণী এসে তাদের পরিচয় জানতে চান। দৃষ্টি তালুকদার নামের ওই তরুণী তাকে শহরের একটি সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রে ভর্তি হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু আছমা প্রথমে রাজি হননি। মেয়ের এক পা নেই, যদি কোনো সমস্যা হয়। কিন্তু দৃষ্টি মাকে বোঝান, নওরিনের দায়িত্ব তিনি নেবেন। একপর্যায়ে আছমা বেগম রাজি হন। নওরিনেরও আগ্রহ ছিল। অবশেষে মায়ের সম্মতি আর দৃষ্টির উদ্যোগে ‘বাতিঘর’ নামের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় নওরিন, নিতে থাকে নাচের প্রশিক্ষণ।

সুনামগঞ্জের বাসায় মায়ের সঙ্গে নওরিন
ছবি: প্রথম আলো

মেয়ের সুবিধার জন্য শহরে একটি বাসা ভাড়া নেন আছমা। গত বছর শহরের সবচেয়ে বড় মঞ্চ হাসন রাজা মিলনায়তনে নাচার সুযোগ পায় নওরিন। বাতিঘর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক ‘থিয়েটার সুনামগঞ্জ’-এর দলপ্রধান দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী তাঁদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনে নওরিনকে মঞ্চে হাজির করেন। নওরিনের এক পায়ের নাচ দেখে বিস্মিত হন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়াসহ অন্যরা। পরে তাকে ডেকে নিয়ে উপহারও দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। ওই দিনের পরই সবাই জানতে পারে নওরিনের কথা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন তার নৃত্যের ভিডিও ভাইরাল। সর্বশেষ ১৫ অক্টোবর ঢাকায় নতুন কুঁড়ির জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনে অংশ নেয় নওরিন।

‘আসলে নওরিনের মাঝে যেটা আছে, সেটা গড গিফটেড,’ বলছিলেন দৃষ্টি তালুকদার। ‘ঢাকায় বিচারকেরা পরিষ্কার বলেছেন, আবেগ বা নওরিনের একটা পা যে নেই, এটি তাঁদের চিন্তায় ছিল না। তাঁরা তার মেধার মূল্যায়ন করেছেন। এই মেয়ে অনেক দূর যাবে...।’

সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ভাদেরটেক গ্রামে নওরিনদের বাড়ি। তবে এখন তারা শহরে থাকে। বাবা নাজমুল হক একসময় প্রবাসে ছিলেন। তার একমাত্র বড় বোন নাজিফা নাওলা উচ্চমাধ্যমিক পাস করে মেডিকেল কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নওরিন যে এত ভালো করবে, এটি ভাবতে পারেননি আছমা বেগম। নওরিনের নৃত্যচর্চায় পরিবারের সমর্থন ও সহযোগিতা থাকবে—এমনটা শোনান তিনি।

নওরিন কথা বলে কম, মায়াভরা চোখে কখনো মা, কখনো তার প্রশিক্ষকের দিকে তাকায়, মাঝেমধ্যে হাসে। ‘আমি খুব খুশি, নাচ চালিয়ে যাব, তবে সবার আগে পড়াশোনা,’ একফাঁকে অল্প কথায় আমাদের জানায় নওরিন।

আরও পড়ুন