মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী
সুন্দরবনে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার লড়াই
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো।
সংগ্রহকারী: রিয়াজ উদ্দিন, সপ্তম শ্রেণি (স্মৃতিকথা সংগ্রহের সময়), বাঙ্গালহালিয়া উচ্চবিদ্যালয়, রাজস্থলী, রাঙামাটি
বর্ণনাকারী: মোফাজ্জেল ফরাজী, শফিপুর, রাঙামাটি
সংগ্রহকারী ও বর্ণনাকারীর সম্পর্ক: নাতি–দাদা
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম বাগেরহাটের শরণখোলায়, জায়গাটা সুন্দরবনের কাছাকাছি। সেদিন বাড়ি থেকে আমরা আটজন সুন্দরবনের দিকে রওনা হয়েছিলাম কাঠ কাটার জন্য। নৌকায় করে কিছু দূর যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন জানাল, আজ এখানে যুদ্ধ হতে পারে।
পাশেই ছিল আমার এক আত্মীয়ের বাসা। পরিস্থিতি বুঝে সঙ্গীদের নিয়ে ওই আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম। আর সত্যি সত্যিই কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মুক্তিযোদ্ধারা সুন্দরবনের ভেতর লুকিয়ে ছিলেন। আর পাকিস্তানি বাহিনী এসেছিল শরণখোলা থানার দিক থেকে।
পাকিস্তানি বাহিনী এলাকায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে ফেললেন। আমরা তখন ঘরে বসে শুধু গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। চারদিকে শুধু ধোঁয়া।
প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা যুদ্ধ চলল। বেশ কজন রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনা নিহত হলো। আর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শহীদ হলেন দুজন। এর মধ্যে জগেশ কান্ত সুতার নামের একজন সাধারণ নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। তাঁকে গুলি করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল।
যুদ্ধ শেষেও ভয়ে আমরা বাইরে বেরোলাম না। আমরা রওনা হয়েছিলাম চারটি নৌকায়, এক নৌকায় দুজন করে। শেষমেশ ঠিক করলাম, আত্মীয়ের বাসায় রাতটা থাকব। এক দিন পর খালি নৌকা নিয়ে ঘরে ফিরলাম। ফেরার পথে দেখলাম, নদীতে তিনটি লাশ ভেসে যাচ্ছে।
বাড়ি ফেরার পর আরেকটি ঘটনা ঘটল। আমার এক মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে আগুন দিল পাকিস্তানি সেনারা। কয়েক দিন পর পুড়িয়ে দিল অনেক হিন্দুধর্মাবলম্বীর ঘরবাড়ি। কাউকে কাউকে নদীর ধারে নিয়ে মেরে ফেলল গুলি করে।