উত্তরবঙ্গের মাটির ঘরবাড়িগুলো কেন আলাদা

লিখেছেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজির ডিন এবং স্থাপত্য বিভাগের প্রধান সাজিদ বিন দোজা

লেখকের করা স্কেচ

বাংলার সীমাহীন সবুজের সমারোহ আমাদের মুগ্ধ করে আবহমানকাল ধরে। সবুজের এক খণ্ড মোজাইক যেন আমাদের উত্তরের জনপদ। এই চিরহরিৎ ও সমতল ভূখণ্ডে মাটির বাড়ি যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকা মৃত্তিকা-ভাস্কর্য। হাজার বছরের অভিজ্ঞতার ভান্ডার আমাদের এই গ্রামীণ বসতি। জল, বায়ু ও স্থানীয় প্রজ্ঞার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আমাদের গ্রামের বসতবাড়ি। এলাকাভেদে এই বসতির নির্মাণসামগ্রীতেও ভিন্নতা দেখা যায়। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বরেন্দ্রভূমির অবদানে খানিকটা উঁচু জায়গা, সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৪০-৫০ ফুট উঁচুতে। সেই অঞ্চলের মাটির বাড়ির খ্যাতি আছে বিশেষভাবে। তাই সেসব বাড়ির ব্যাপ্তি, সম্ভার ও নির্মাণশৈলী নিয়ে আলোকপাত করব এখানে।

গ্রামীণ বসতির সামগ্রিক নির্মাণ উপকরণ বলতে প্রথমেই আসে মাটি, বাঁশ, খড়কুটো, কাঠ, গোলপাতা, হোগলার পাতা ইত্যাদির নাম। উত্তরবঙ্গে মাটির গাঠনিক অবস্থান শক্তিশালী। এই জনপদে বাংলাদেশের মোট ৫০-৬০ শতাংশ মাটির বাড়ি নির্মিত হয়। আবারও বলতে চাই, আমাদের গ্রামীণ বসতের নির্মাণশৈলীর ধারাবাহিকতা হাজার বছরের পারস্পরিক ও পূর্বপুরুষের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান আজও সমুন্নত, পরীক্ষিত ও স্বীকৃত। গ্রামীণ বাংলার পরিপাটি চালাঘরের স্থাপনা সম্রাট অশোকের সময় থেকে, পাল, সুলতান, মোগল ও ব্রিটিশ রাজ-স্থাপত্যে অনুকরণীয় ছিল। প্রচণ্ড শক্তিশালী অনুকরণীয় মাধ্যম হয়ে উঠেছিল গ্রামীণ বাংলার ঘর এবং অবকাঠামো; প্রাচীন, প্রাক্‌–মুসলিম ও পরবর্তী সময়। উত্তরের এই জনপদে মাটির বসতবাড়িগুলো দোতলা, এমনকি তিনতলাও দেখা গেছে।

এই অঞ্চলের নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, বরিন্দ, নাচোল, দিনাজপুর ও তানোর এলাকাতে মাটির বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। চান্দুরিয়া, নজিপুর, পত্নীতলা, নওগাঁয় ঘনবসতিপূর্ণ দ্বিতল মাটির বাড়ির সমাবেশ এখনো উপস্থিত। এই লেখনীতে আমরা মাটির বাড়ির কিছু নির্মাণকৌশল, পরিবেশ, অবকাঠামো এবং স্থাপতিক ও কারিগরি সম্পৃক্ত একক কিছু স্কেচ নিয়ে আলোচনা করব।

প্রধান দালানটি অনেক কিছুর সমন্বয়ে তৈরি হয়
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

প্রধান উপকরণ মাটির প্রস্তুতি

মাটির বসতবাড়ির গঠন মাটির ব্লক নির্মাণের মাধ্যমে হয়। বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাটির প্রস্তুতি নেওয়া হয়। যেখানে ঘর বানানো হবে, ঠিক তার আশপাশে নিচু এলাকায় মাটির মণ্ড, খড়কুটো, বিভিন্ন গাছের পচা পাতার পানি, তেঁতুলের পানি ইত্যাদি নিচু ওই জায়গাতে মিশিয়ে মাটি প্রস্তুত করা হয়। মাটি প্রস্তুতির সঙ্গে অনেক শ্রমিকের সম্পৃক্ততা থাকে। পায়ের দ্বারা মাটির মণ্ড কসরতের সঙ্গে দলাই-মলাই করা হয়। একপর্যায়ে মাটির মণ্ড প্রস্তুত হয় এবং নির্মাণকাজের জন্য সাইটে ব্লক আকারে পাঠানো হয়। ১৫-২০ জন এই যজ্ঞের সঙ্গে জড়িত থাকেন।

ভিত্তি খনন

ঘরের নকশা অনুযায়ী ভিত্তি খনন করা হয়। গভীরতা থাকে সাধারণত দুই থেকে তিন ফুট। ওই একই গভীরতা থেকে প্রস্তুতকৃত মাটির মণ্ড দ্বারা প্রশস্ত ভিত্তির স্থাপনা শুরু হয়ে যায়। এ ধরনের মোটা মাটির ভিত্তিকে ‘কাথি’ বলে। মাটির দেয়াল একবারে বেশি উঁচু করে নির্মাণ করা যায় না। দু-িতন ফুট পর্যন্ত উঁচু করার পর সেটা জমতে বা শুকাতে সময় দিতে হয়। পরের দিন আবার মাটির ব্লক দিয়ে নির্মাণকাজ শুরু হয়। দেয়ালের গঠন নিচ থেকে ওপরের দিকে কমতে থাকে। মানে ভিতের অংশটি মোটা হয় আর অপেক্ষাকৃত ওপরের অংশটি ধীরে ধীরে চিকন হয়। কারণ, ট্যাপারিং দেয়াল হওয়ার কারণে সহজে সেটা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, উল্লম্ব ভার শিথিল হয়ে যায়।

দেয়াল নির্মাণ একটি বিশেষ প্রক্রিয়া। দ্বিতল হলে দেয়ালের মাঝখানের নতুন তলের ‌সন্নিবেশন ঘটে, প্রথম তলাটি আড়ষ্টভাবে দেয়ালের সঙ্গে কাঠামোর ব্যাকরণে স্থানীয় প্রজ্ঞায় নির্মিত হয়।

মাটির ঘরের নির্মাণকৌশলে বিশেষ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মেলে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

কাথি নির্মাণ

ভিত্তির ওপরের অংশটি বিশেষভাবে আলাদা অংশ হয়। চোখে পড়ার মতো বর্ধিত মাটির গাঁথুনি, যেটি সরাসরি মাটি থেকে ওঠা শুরু করে, সাধারণত উচ্চতায় চার ফুট মতো ওঠার পর প্রধান দেয়ালটির নির্মাণপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। কাথি আসলে ভিত্তির প্রধান অংশ। মাটির বাড়ির পরিপূর্ণ গঠন, ব্যালান্স এবং বলিষ্ঠতার মানদণ্ড।

প্রধান দালান

প্রধান দালানটি অনেক কিছুর সমন্বয়ে তৈরি হয়। যেমন দেয়াল, দরজা ও জানালার অবস্থান ও লিনটেল প্রস্তুত করা ইত্যাদি। জানালা ও দরজায় খোলা জায়গা রাখার জন্য কাঠের তক্তা উপরিভাগে বসানো হয়, যেন সেটা ওপরের মাটির ভার যথাযথ প্রক্রিয়ায় বহন করতে পারে। কাঠের তক্তাটির প্রশস্ততা মাটির দেয়ালের প্রশস্ততার সম্পূরক। একইভাবে দরজা ও তার লিনটেল স্থাপন করা হয়।

সাধারণত দরজা-জানালা কাঠের বানানো হতো। জানালার নিরাপত্তার জন্য লোহার শিক ব্যবহৃত হয়। দেয়ালের নিজস্ব গভীরতা থাকায় জানালা ও দরজার ভেতর দিকে দ্বিতল মাটির বসতে স্থাপিত হওয়ায় রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়। এই স্থাপনা আবহাওয়া সংবেদনশীলও। বাংলার মাটির বসত নির্মাণের সঙ্গে পরিবেশ ও বাস্তুশাস্ত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক আছে।

প্রথমতল প্রস্তুতি

সাধারণত ৭-৯ ফুট উচ্চতায় প্রথম তলাটি নির্মাণের মাধ্যমে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। নির্মাণ উপকরণ হিসেবে তালগাছের কাঠ, বাঁশ ও চাটাই নির্ধারিত কৌশলে একটির ওপর অন্যটি শক্ত ও মজবুতভাবে বসানো হয়। প্রথমে তালগাছের গুঁড়ি আড়াআড়ি দিক থেকে দুটি প্রধান দেয়ালের ওপর বসানো হয়, এরপর বাঁশকে ঘনভাবে সন্নিবেশন করে বিপরীত দিকনির্দেশনাতে স্থাপন করা হয়। রশি, তার ও কাঁটার দ্বারা সংযোগগুলো শক্তভাবে বাঁধা হয়। প্রস্তুত হয়ে গেল শক্তিশালী কাঠামো। এর ওপরে চাটাই সমান করে বসানো হয়। পরবর্তী সময়ে মাটির আস্তরের মাধ্যমে প্রথম তলের কর্মক্রিয়া সম্পাদন করা হয়।

নকশাবিন্যাস

মাটির ঘরে বিশেষ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাই নকশায়। দুই ধরনের স্থানের অবস্থান দেখা যায় মাটির ঘরের নকশাবিন্যাসে। একটি ব্যবহারযোগ্য স্থান আর অন্যটি পরিবেশনার জায়গা। অন্যভাবে বললে একটি হবে সার্ভ স্পেস আর অন্যটি সার্ভিস। দ্বিতল বড় ভবনটি উত্তর-দক্ষিণে উন্মুক্ত থাকে। আর এই অংশে নিচতলাতে বসার ঘর, অতিথিশালা ও একটি শোবার ঘর বিদ্যমান। এর ঠিক ওপরে বাকি তিনটি শোবার ঘর নকশায় দেখা যায়। এসব ঘরে যাওয়ার জন্য নিচে একটি আধা খোলা বারান্দা আছে। এর ঠিক ওপরে একটি ঝুলন্ত বারান্দার মাধ্যমে বাকি তিনটি ঘরে যাওয়া যায়। এই ঝুলন্ত বারান্দাটিকে স্থানীয় লোকজন বলেন ‘পীড়া সাজানি’। সুন্দর একটি কাঠের জাহাজি সিঁড়ি দিয়ে ওপরের তলায় ওঠা যায়।

এবার আসি উঠান ঘিরে অন্যান্য অবকাঠামোর অবস্থান বর্ণনায়। একতলা মাটির দালানের সমন্বয়ে এই অংশকে বলা হয় পরিবেশনার স্থান। এই অংশে বাড়ির মূল প্রবেশদ্বার এবং এর সঙ্গে একটি স্থান অবমুক্ত থাকে। বিশেষ এই স্থানের নাম ‘আকসালি’ (ফায়ার স্পেস) বলে অভিহিত করা হয়। কুয়াতলা, হেঁশেল, পুকুরের দিকে যাওয়ার দ্বার, প্রক্ষানালয়, স্নানঘর, গুদামঘর, গোয়ালঘর ইত্যাদির সমন্বয়ে কার্যকর স্থানটি বিন্যাস হয়।

উঠান

গ্রামবাংলার বসত হাজার বছর ধরে উঠানসমৃদ্ধ। এটি বসতের শক্তিশালী একটি স্থান, যেখান থেকে বাংলার সহজ-সরল স্থাপত্যের সত্যতা প্রকাশ পায়। আবহমানকাল ধরে গ্রামবাংলার বসতভিটার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে উঠান। একটি আঙিনা বা উঠান স্থানীয় জলবায়ুর আধার (মাইক্রোক্লাইমেট)। উঠান একটি ফাঁকা স্থান হওয়ার কারণে সার্বক্ষণিক বাতাসপ্রবাহের সৃষ্টি হয়, গরম বাতাস ওপরে উঠে যায় আর ঠান্ডা বাতাসকে উঠানে প্রবাহিত হতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ঘরে বাতাস প্রবেশ করে অন্যান্য দরজা অথবা জানালার মাধ্যমে আড়াআড়ি বায়ুপ্রবাহের (ক্রস ভেন্টিলেশন) পথ তৈরি হয়। উঠান আবার আলোরও উৎস। যেখানে কমবেশি সূর্যের কিরণ পাই আমরা। উঠানসমৃদ্ধ বসত দিনের সব সময় বাসিন্দাদের বিভিন্ন কাজে জড়িত থাকে।

শীতকালে উষ্ণতা প্রদান আর গ্রীষ্মকালে আরামদায়ক তাপমাত্রার আধার অনন্য এসব উঠানসহ মাটির বাড়ি। পুরু দেয়ালে তাপমাত্রা ধারণক্ষমতা অধিক থাকার ফলে এই পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

সমসাময়িক স্থাপত্যচর্চাতে হাজার বছরের পরীক্ষিত উঠান অনুকরণীয় হওয়া উচিত স্থপতিদের।

পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি

নদীমাতৃক ভূখণ্ডে মাটির বাড়ি এবং এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন অতি সাবলীল, সাধারণ অথচ একক বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধান। মানুষ, মাটি ও প্রকৃতির অন্তর্নিহিত সৃষ্টিশীলতার বহিঃপ্রকাশ আমাদের গ্রামবাংলার মাটির বসতবাড়ি। এই বসতে শুধু মানুষ বাসিন্দাই নয়, আশ্রয় পায় গরু-ছাগল, কবুতরসহ নানা পশুপাখির মতো প্রাণিকুল।

বাংলার মাটির বাড়ির সমৃদ্ধ ইতিহাস ও বহমান সাংস্কৃতিক ধারাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে নতুনের হাত ধরে। আর তা নাহলে আমাদের মায়াময় মাটির বাড়ি স্থান পাবে জাদুঘরে, যা মোটেও কাম্য নয়।

লেখাটি প্রথম আলোর বিশেষ ম্যাগাজিন বর্ণিল বসতে প্রকাশিত