জুতা
বহু বছর আগের গল্প। তবে সত্যি গল্প। গল্পটা আমার বাবাকে নিয়ে।
আমরা তখন বগুড়ায় থাকি। আমি পড়ি ক্লাস টুতে, বগুড়া পিটি স্কুলে। বাবা সম্ভবত পুলিশ ইন্সপেক্টর। আমাদের বাসা বগুড়ার সাতমাথা থেকে একটু ভেতরের দিকে; জায়গাটার নাম ছিল বোধ হয় সূত্রাপুর। সিঅ্যান্ডবির বিশাল মাঠের পাশেই আমাদের সুন্দর একতলা বাড়ি। দেখতে দেখতে একদিন সেই বাড়ির দোরগোড়ায় এসে হাজির হলো ঈদ। আমি বায়না ধরলাম, জুতা কিনে দিতে হবে। বায়না–টায়না সব বাবার কাছেই। বাবা ছিলেন একটু ‘ইকোফ্রেন্ডলি’ আরকি। আর মা একটু কড়া। মা বললেন, ‘নতুন জুতার দরকার কী! আগেরটা পলিশ করিয়ে আনলেই হবে।’
বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে, চলো।’
বাবার সঙ্গে এ-দোকান ও-দোকান ঘুরতে ঘুরতে একটি দোকানে এক জোড়া লাল জুতা আমার পছন্দ হলো। বাবা জানতে চাইলেন, ‘দাম কত?’
দাম শুনে বাবা বললেন, ‘চলো, অন্য দোকানে দেখি।’
অন্য দোকানে ঘোরাঘুরি করলাম বটে, কিন্তু আমি ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলাম। ওই জুতাই আমার লাগবে। আমার ঘ্যানঘ্যানানির ভাঙা রেকর্ড বাজতেই লাগল। কী আর করা, শেষমেশ বাবা আবার ওই আগের দোকানে গিয়ে জুতাজোড়া কিনলেন। তবে ব্যাপারটা মনে হয় তাঁর পছন্দ হলো না। জুতাটার আসলে অনেক দাম ছিল বোধ হয়। তবে দোকানদার জুতার সঙ্গে একটা বেলুন দিলেন। বেশ বড় লাল একটা বেলুন। ফুঁ দিলে একটা ফুটবলের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে।
বাসায় ফিরে কিসের জুতা কিসের কী! আমি বেলুন নিয়ে পড়লাম। বেলুন ফোলাই আর ছেড়ে দিই। বাতাস ছাড়তে ছাড়তে দিব্যি রকেটের মতো ওপরে উঠে যায় বেলুন। আবার ফোলাই আবার ছেড়ে দিই, আবার ফরফর শব্দ করতে করতে রকেটের মতো উঠে যায়। এ-ই চলছে। মা পর্যন্ত বিরক্ত, ‘এর মানে কী! এত দাম দিয়ে জুতা কিনে পায়ে দিয়ে দেখল না! বেলুন নিয়ে আছে।’
বাবা অবশ্য আমার কাণ্ড দেখে হাসেন।
বিকেলে পাড়ার বন্ধুরা সব ঘিরে ধরল।
‘বাপ রে! কত বড় বেলুন!’
‘দে তো, একটু ফুলাই।’
‘এত বড় বেলুন! কোথায় পেলি?’
আমি অবশ্য বেলুন হাতছাড়া করি না। কাউকে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এতে অবশ্য উল্টো প্রতিক্রিয়া হলো। বন্ধুরা খুব দ্রুত শত্রু হতে শুরু করল।
‘এহ্, কী না এক বেলুন, তা–ই নিয়ে এত দেমাগ!’ এ ধরনের কথাবার্তা কানে আসতে লাগল। তাতেও আমার হুঁশ হলো না। রাবারের বেলুন দিয়ে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে শুরু করেছি যেন। তবে এক রাতে ঘটল মর্মান্তিক ঘটনা।
তখন আমি বেলুনটা বালিশের নিচে রেখে ঘুমাতাম। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, রহস্যময় কারণে বেলুনের ভেতরটা আঠার মতো গায়ে গায়ে লেগে গেছে। ফুঁ দিলেও আর ফুলছে না। ত্রাহি চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। মা, বাবা, ভাই, বোন—সবাই ছুটে এল।
‘কী হলো?’
‘ই ই ই...বেলুন ফুলছে না!’
বেলুন নিয়ে গবেষণা করেও ভাই–বোনেরা কারণ উদ্ঘাটন করতে পারল না। বাবা বললেন, ‘কেন বেলুনটা এমন হয়েছে আমি জানি!’
‘কেন?’
‘তুমি তোমার বন্ধুদের এই বেলুন নিয়ে খেলতে দিয়েছিলে?’
আমি মাথা নাড়ি, দিইনি।
‘এ জন্যই এমন হয়েছে। কোনো জিনিস নিয়ে একা খেলতে হয় না, শেয়ার করতে হয়...।’
বাবা আরও কী সব ভালো ভালো কথা বললেন। সবাই মাথা নাড়ল। আমি অবশ্য ঘাড় গোঁজ করে বসে রইলাম। আর তখনই মনে পড়ল, আরে, কী আশ্চর্য! আমি তো ওই বেলুনটার মতো এক জোড়া লাল সুন্দর জুতা কিনেছি! তারপর আর কী, লাল বেলুনের দুঃখ ভুলতে বেশি সময় লাগল না। জুতা পরে কখন বন্ধুদের (নাকি শত্রুদের) দেখাব, তার তর সইছিল না।
ভাই–বোনেরা বলল, ‘কী রে, ঈদের জুতা এখনই পরে ফেললি?’
‘কী হয় পরলে?’ আমি তখন ভাবতে শুরু করেছি, বন্ধুরা যদি বলে, ‘দে তো তোর জুতাজোড়া একটু পরি।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে খুলে দেব। লাল বেলুনের মতো কিপটামি করব না। কখনোই না।
তারপর বহু বহু বছর কেটে গেছে। আমি নিজেও আমার বাবার মতো একজন বাবা হয়েছি। অবশ্য আমি আমার বাবার মতো অত ভালো বাবা হয়তো হতে পারিনি। আমার সেই ছোট্টবেলার ভালো বাবাটাকে স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি মিলিটারিরা গুলি করে মেরে ফেলল। বাবার শরীরটা যখন বলেশ্বর নদে ভেসে যাচ্ছিল, তখন কিছু মানুষ তাকে তুলে এনে কবর দিল। প্রমাণস্বরূপ রেখে দিল তাঁর দাপ্তরিক জুতাজোড়া। সেই জুতাজোড়াও কিন্তু ছিল লাল রঙের। বাবার কিনে দেওয়া সেই ছোট্ট লাল জুতাজোড়াই যেন অনেক অনেক অনেক বড় হয়েছে, আর আমরা সবাই দূর থেকে তাকিয়ে দেখছি
অবাক বিস্ময়ে!
(কার্টুনিস্ট ও লেখক আহসান হাবীবের বাবা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পিরোজপুরের মহকুমা পুলিশপ্রধান। ১৯৭১ সালের ৫ মে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন তিনি।)